StudyMamu

ইতিহাস রচনার মধ্যে চূড়ান্ত বস্তুনিষ্ঠতা কতদূর সম্ভব

April 15, 2022


ইতিহাস রচনার মধ্যে চূড়ান্ত বস্তুনিষ্ঠতা কতদূর সম্ভব



  ঐতিহাসিক বা ইতিহাস লেখক একজন মানুষ এবং প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু কিছু মানসিক প্রবণতা বা চিন্তাভাবনা থাকে যাকে বলা হয় পক্ষপাতিত্ব বা ‘biasness’। এই মানসিক প্রবণতা বা পক্ষাপতিত্বের কারণেই ইতিহাসে ঘটে যাওয়া একই ঘটনা বা কোন ঐতিহাসিক চরিত্রকে এক এক জন ঐতিহাসিক এক এক ভাবে বা নিজের মতানুসারে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে থাকেন। দেশ, কাল ও মানুষের ইতিহাস ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ভুলে যান যে তিনো কালের পুতুল। কোন নির্দিষ্ট দেশে তার জন্ম, কোন নির্দিষ্ট কালে তাঁর শিক্ষা, গবেষণা ও রনা সীমাবদ্ধ। ক্ষেত্রবিশেষে এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে, যেমন ঘটেছিল ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসের ক্ষেত্রে বা বিংস শতকে নেমিয়ারের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণ করে।




 ইম্যানুয়েল ওয়ালারস্টাইন সম্পাদিত ‘Open the Social Sciences’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে কোন তথ্যই বাস্তব থেকে সংকলিত বা গৃহীত হয়, সেই সকল তথ্যের উপর সেই যুগের বিশ্বচিন্তন ও তাত্ত্বিক পরিকাঠামোর স্পষ্ট প্রভাব থাকে, এগুলিকেই আবার প্রত্যেক যুগের বিশেষ কোন গোষ্ঠী বা শ্রেণির দৃষ্টিকোণের মধ্যে দিয়ে হেঁকে নেওয়া হয়। (All data are selections from reality, beased on the world views or theoretical models of the era, as filtered through the standpoints of particular groups of each era) ঐতিহাসিকচাইলেই মার্কস ও লেনিন, ফ্রয়েড ও আইনস্টাইন, কেইনস্ ও ফ্রিডম্যান, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেননা। ঐতিহাসিকের বাছাই করা তথ্যও নিজের দেশ, পৃথিবী এবং সর্বোপরি প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে যাবে। ইন্টারনেট এর বিপ্লবের ফলে যে তথ্য বিপ্লব ঘটে গেছে তার প্রভাব ঐতিহাসিকের উপর পড়বেই।



 এলাহাবাদ প্রশক্তি রচনাকালে সমুদ্রগুপ্তের প্রতি হরিয়েন এর দায়বদ্ধতা বা হর্ষচরিত রচনাকালে পৃষ্ঠপোষক হর্ষবর্ধনের প্রতি বানভট্টের দায়বদ্ধতা বা আইহোল প্রশস্তি রচনাকালে দ্বিতীয় পুলকেশির প্রতি রবীকীর্তির দায়বদ্ধতা বা আকবরনামায় আবুল ফজলের আকবরের প্রতি দায়বদ্ধতা সর্বজনবিদিত একটি বাস্তব সত্য। ইতিহাস রচনার সময়কালে একজন ঐতিহাসিক নিশ্চিতভাবেই তাঁর সময় ও মানসিক চেতনা ও চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হন, তাঁর মননের মধ্যে দিয়েই পাঠক অতীতকে দেখেন।




  ই এইচ কার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘What is History তে উল্লেখ করেছেন যে বিভিন্ন ধরনের মানসিক প্রবনথা থাকার ফলে কোনো ঐতিহাসিক পক্ষেই ঐতিহাসিক ঘটনার চরম বস্তুগত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়, একজন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক হলেন তিনিইযিনি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিজের সমাজ ও সময়কালের সংকীর্ণ চেতনার উর্দ্ধে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন এবং ভবিষতাকে এমনভাবে উপস্থাপিত করেন যা অতীতের বা অতীত ঘটনার দ্বারা আলোকিত জীবন্ত ও মূর্ত হয়ে ওঠে। Objective History বা ইতিহাসের মনায় ব্যাখ্যা সম্পর্কিত কারের এই মতের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে র‍্যাঙ্কে প্রদর্শিত Objective History সংক্রান্ত প্রথাগত ধারণা। এই ধারণা অনুযায়ী একজন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক হলেন তিনিই যিনি সঠিক তথ্যের যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের সাহায্যে ইতিহাস রচনা করেন, তাঁর ব্যক্তিগত চেতনা এই ব্যাখ্যাতে ক্রীয়াশীল হলেও ইতিহাসের বস্তুগত ভিত্তি বিনষ্ট হয় না। অন্যভাবে বললে objectivity’ হল একজন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক দ্বারা ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও আবেগহীন ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন।



 অন্য ব্যক্তিদের মতোই ঐতিহাসিক নিজেও একজন সামাজিক জীব, যিনি সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে নিজের সমাজব্যবস্থার মুখপায়ের ভূমিকা পালন করে থাকেন। বস্তুতপক্ষে ইতিহাস হল এক চলমান শোভাযাত্রা ঐতিহাসিক সেই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী একজন পথিক। ঐতিহাসিকের এই সহজাত পূর্বসংস্কার, শ্রেণিস্বার্থ, রুচি ও প্রবণতা তথ্য নির্বাচন ও ব্যাখ্যাকে প্রভাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক। ইম্যানুয়েল ওয়ালারস্টাইন সম্পাদিত ‘Open the Social Sciences’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে কোন তথ্যই বাস্তব থেকে সংকলিত বা গৃহীত হয়, সেই সকল তথ্যের উপর সেই যুগের বিশ্বচিন্তন ও তাত্ত্বিক পরিকাঠামোর স্পষ্ট প্রভাব থাকে, এগুলিকেই আবার প্রত্যেক যুগের বিশেষ কোন গোষ্ঠী বা শ্রেণির দৃষ্টিকোণের মধ্যে দিয়ে হেঁকে নেওয়া হয়।




 ঐতিহাসিকচাইলেই মার্কস ও লেনিন, ফ্রয়েড ও আইনস্টাইন, কেইনস্ ও ফ্রিডম্যান, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেননা। ঐতিহাসিকের বাছাই করা তথ্যও নিজের দেশ, পৃথিবী এবং সর্বোপরি প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে যাবে। ইন্টারনেট এর বিপ্লবের ফলে যে তথ্য বিপ্লব ঘটে গেছে তার প্রভাব ঐতিহাসিকের উপর পড়বেই।



  স্বনামধন্য বহু ঐতিহাসিকই বস্তুতান্ত্রিক ইতিহাসের সম্ভবতার বিষয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন মার্কিন ঐতিহাসিক পিটার নোডেক লিখেছেন যে ইতিহাসবিদকে অতীতের তথ্যের প্রতি সম্পূর্ণভাবে দায়বদ্ধ থাকতে হবে অর্থাৎ তার অর্থের কোন অদলবদল করা যাবে না, যেমনভাবে যা পাওয়া গেছে ঠিক তাই লিখতে হবে। র্যাস্তের মতো তিনিই মনে করেন যে একজন ইতিহাবিদকে সব রকম ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির উপরে উঠে নির্মোহ ও পক্ষপাতহীনভাবে ইতিহাসকে উপস্থাপন করতে হবে। 




 ঐতিহাসিক টমাস হ্যাসকেল নোভেক এর ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতার বিষয়টিকে অবাস্তব বলে মনে করেছেন, তাঁর মতে ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতা এবং তাকে বস্তুতান্ত্রিক ভাবে উপস্থাপন করার সঙ্গে নিরপেক্ষতার কোনো সহাবস্থান নেই। তাঁর মতে Objectivity এবং Neutrality’ দুটি সম্পূর্ণ পৃথক ধারণা এবং ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বা অন্য কোনো দায়বদ্ধতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে যখন কোনো ইতিহাস লেখেন তখন কোনোভাবেই তিনি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে পারেননা।



 বস্তুত ইতিহাসের চর্চায়, অউধাবনে এবং উপস্থাপনে ব্যক্তিচেতনার প্রতিফলন ঘটে এবং এর ফলে বিষয়নিষ্ঠা বা বস্তুতান্ত্রিতার ( Objectivity) পরিবর্তে আত্মনিষ্ঠা বা ব্যক্তিতান্ত্রিকতা ( Subjectivity) প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

 



 এই এইচ কার লিখেছেন যে ঐতিহাসিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিষয়মুখিতা ক্রমশ বাড়ছে। ১৮৮০ এর ঐতিহাসিকদের তুলনায় ১৯২০ এর সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের এবং ১৯২০ এর তুলনায় বর্তমান কালের ঐতিহাসিকদের বিষয়মুখিতা তুলণামূলকভাবে অনেক বেশী বলে ঐতিহাসিক কার তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন।বাস্তবতাকে স্বীকার করে ঐতিহাসিক কার মনে করেছেন যে ঐতিহাসিককে ইতিহাসের তন্ময় বা objective’ এবং মন্ময় বা subjective’ ব্যাখ্যার উভয়সংকটের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চালাতে হবে। অর্থাৎ ইতিহাসের সম্পূর্ণ বস্তুতান্ত্রিক বা বিষয়মুখী ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।

Share Post :

Leave a Comment