StudyMamu

টীকা লেখ হোমরুল আন্দোলন

July 25, 2022

 

টীকা লেখ – হোমরুল আন্দোলন  । হোমরুল আন্দোলন টিকা । 

ভূমিকা : 

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর আয়ারল্যান্ডের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। শিক্ষিত ভারতীয়রা আইরিশদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত। দুই দেশ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের শিকার, দুই দেশই নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য ব্রিটিশ বিরোধিতায় নেমেছিল। শিক্ষিত ভারতীয়দের কাছে এডমন্ড বার্ক ও ডানিয়েল ও কনেল ছিলেন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ও কনেলের ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশন শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক আন্দোলনের নজির স্থাপন করেছিল। বার্ককে শ্রদ্ধা করা হত কারণ তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসকে অভিযুক্ত করেছিলেন। আয়ারল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করা হত। 

হোমরুল আন্দোলনের প্রেক্ষাপট / পটভূমি। 

আইজাক বাট (Butt) আয়ারল্যান্ডে হোমরুল আন্দোলন গড়ে তুললে ভারতীয়রা প্রভাবিত হন। এই আন্দোলনের ফলে আয়ারল্যান্ডকে হোমরুল দানের কথা ভেবেছিলেন গ্ল্যাডস্টোন কিন্তু দু-দুবার তাঁর উত্থাপিত বিল বাতিল হয়ে যায়। আইরিশরা এর পরে সিনফিন আন্দোলন গড়ে তুলে স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে জোরদার করে তুলেছিল। জন রেডমন্ড এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, তিনি পার্নেলকে অনুসরণ করেছিলেন। এরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ভেঙে না দিয়ে সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দাবি করেছিলেন। শেষপর্যন্ত ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে আইরিশ হোমরুল বিলটি পাশ হয়েছিল।

আয়ারল্যান্ডের হোমরুল আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হন আইরিশ মহিলা অ্যানি বেসান্ত। তিনি এ ধরনের আন্দোলনের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে ভারতে তা গড়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন। এই পর্বে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নানা কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য নিয়ে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। চরমপন্থীরা কংগ্রেস ছেড়ে চলে যায় (১৯০৭ ১৯১৬), নরমপন্থীদের হাতে ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্ব। কংগ্রেসের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ ছিল না, প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে গণ্য করা হত না। চরমপন্থীরা ছিল বিচ্ছিন্ন, তারা পালটা সংগঠন গড়ে তোলার কথা ভাবেনি।

বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তিলক জেল থেকে মুক্তি পেলে আবার ঐক্যের কথা তোলা হয়। কংগ্রেসকে কার্যকর করে তোলার জন্য তিনি চিন্তাভাবনা শুরু করেন। যুদ্ধের মধ্যে দুধরনের মানসিকতা জাতীয়তাবোধ ও সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য পাশাপাশি বহমান ছিল। শেষদিকে জাতীয়তাবাদ প্রবল হয়ে উঠেছিল। থিওজফিক্যাল সোসাইটির সদস্যা হিসেবে বেসান্ত ভারতে এসেছিলেন, তাঁর ছিল প্রবল ব্যক্তিত্ব ও প্রখর বাগ্মিতা।

৬৭ বছর বয়সে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। দুটি পত্রিকা কমনউইল ও নিউ  ইন্ডিয়া-র তিনি ছিলেন সম্পাদিকা। নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের ঐক্যবন্ধ করে তিনি জাতীয় আন্দোলনকে জোরদার করার কথা ভেবেছিলেন। তিনি ভারতের জন্য স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেন, ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বের কথাও তিনি বলেছিলেন। তিনি ভারতকে দেন হোমরুলের ধারণা, ধারণাটিকে তিনি জনপ্রিয় করে তোলেন, তিনি এটিকে “বিচ্ছিন্নতা ছাড়া স্বাধীনতা’ বলে অভিহিত করেন (freedom without separation)। তিলকও আইরিশ হোমরুল আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঐ ধরনের আন্দোলন গঠনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। বেসান্ত নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে ব্যর্থ হন।

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বালগঙ্গাধর তিলক হোমরুল আন্দোলনের সূচনা করেন। ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে বেসান্ত পৃথকভাবে হোমরুল লিগ গঠন করেন। দুটি লিগের উদ্দেশ্যে ছিল শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের জন্য স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায় করা। দুই লিগের মধ্যে রেষারেষি ছিল না, বরং সহযোগিতা ছিল। দেশের সব বড়ো বড়ো শহরে দুই লিগের শাখা স্থাপিত হয়েছিল। সংবাদপত্রের মাধ্যমে লিগের উদ্দেশ্য প্রচার করা হয়েছিল, লিগ সভা সমিতির আয়োজন করে বক্তৃতার ব্যবস্থা করত। দুই লিগ বহু প্রচার পুস্তিকা ছাপিয়ে জনগণের মধ্যে বিলি করেছিল। দুই লিগের চাঁদা প্রদানকারী সদস্য ছিল। তিলকের লিগের কাজকর্ম কেন্দ্রীভূত ছিল মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক অঞ্চলে, বেসান্তের লিগের কাজকর্ম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে বহু লিগসদস্য যোগ দিয়েছিল, নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। হোমরুলপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার চেয়েছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা হয়নি। এরা কখনও ব্রিটিশের শাসনের অধিকার অস্বীকার করেনি যদিও তারা দাবি করেছিল স্বায়ত্তশাসন হল ভারতীয়দের জন্মগত অধিকার। তিলক বলেছিলেন সম্রাট হলেন অদৃশ্য ব্রহ্মের মতো, ভারতের শাসকগোষ্ঠী হল মায়া। তিনি বলেছিলেন আমলাতন্ত্রকে সরিয়ে ভারতীয়দের হাতে স্বশাসনের অধিকার তুলে দিতে হবে।

ভারতীয় প্রজারা সম্রাটের প্রতি অনুগত, এই দাবির মধ্যে বিদ্রোহের কোনো উপাদান নেই। তিলক অন্য এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ভারতে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা হল পুরোহিতের, ভারতীয়দের পুরোহিত বা মধ্যস্থের প্রয়োজন নেই। তিলক তৎক্ষণাৎ হোমরুল দেবার কথা বলেননি। তিনি ব্রিটিশরাজকে অনুরোধ করেছিলেন এব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে যাতে ধীরে ধীরে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা স্থাপিত হতে পারে (All that he wanted was a real beginning and the goal to be reached within a fixed period of time)।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ভারতে হোমরুল আন্দোলন চলেছিল। হোমরুলপন্থীরা শুধু অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও অন্যান্য সাম্রাজ্যিক বিষয় তারা ব্রিটেনের হাতে রাখতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যান্য উপনিবেশের মতো তারা ডোমিনিয়ন হতে চেয়েছিল যাতে অন্যান্য উপনিবেশ ভারতকে মর্যাদা দেয়। বিপিনচন্দ্র পাল হোমরুলপন্থীদের বলেছিলেন ইউনিয়নিস্ট ও ইম্পিরিয়ালিস্ট, অন্যেরা বলেছেন ন্যাশনালিস্ট ইম্পিরিয়ালিস্ট। যুদ্ধের মধ্যে সাম্রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে নতুন বিন্যাসের কথা উঠেছিল, ঠিক একারণে হোমরুলপন্থীরা স্বশাসনের দাবিকে জনগণের মধ্যে প্রচার করেছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাতে হলে হোমরুলের বিকল্প নেই।

হোমরুল আন্দোলনের প্রসার : 

হোমরুল আন্দোলন শুধু শিক্ষিত ভারতীয়দের কাছে নয়, সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনের জনপ্রিয়তা দেখে শঙ্কিত বোধ করেছিল। মাদ্রাজ সরকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ছাত্ররা হোমরুল আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, গ্রামে স্থানীয় ভাষায় প্রচার পুস্তিকা ছাপিয়ে বিলি করা হচ্ছে, আইনজীবীরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বেসান্তের নিউ ইন্ডিয়া প্রচুর বিক্রি হত যাতে হোমরুলের দাবি থাকত। সরকারি কর্মচারী ও ইংরাজি শিক্ষিত মানুষজন এই আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ভারত সরকারের হোম মেম্বার ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে লিখেছিলেন যে জনগণের ওপর নরমপন্থীদের কোনো প্রভাব নেই, তিলক ও বেসান্তের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে।

হোমরুল আন্দোলনের ফলাফল : 

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ভারত সরকার প্রাদেশিক সরকারগুলিকে হোমরুল আন্দোলন দমন করার নির্দেশ পাঠিয়েছিল। আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি দিতে বলা হয়, ছাত্রদের হোমরুলের সভা-সমিতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বলা হয়েছিল। সরকার যে হোমরুলের পক্ষে নয় সেকথা জানিয়ে দেওয়া হয়। ভাইসরয় ভারতসচিবকে এ সম্পর্কে একটি ঘোষণা জারি করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে কোনো বিভ্রান্তি না দেখা দেয়। ভাইসরয় আরও জানিয়েছিলেন হোমরুল আন্দোলন দেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করেছে (The agitation is having a mischievous effect on public feeling throughout the country)। হোমরুলপন্থীরা সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে ক্রমাগত আক্রমণ করে এর নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। 

ঐতিহাসিকদের মতে, ভারতসচিব মন্টেও ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট যে ঐতিহাসিক ঘোষণাটি জারি করেন তা ছিল হোমরুল আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল। হোমরুলপন্থীদের সামনে বিপজ্জনক বক্তৃতাদানের জন্য তিলকের বিচার হয় কিন্তু তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। বেসান্ত ও তাঁর দুই সঙ্গী জি. এস. অরুভালে ও বি. পি. ওয়ানিয়া বন্দি হন। এই ঘটনার  প্রতিবাদে সারা দেশ মুখর হয়ে উঠেছিল, আন্দোলন স্তব্ধ হয়নি, বরং আরও জোরদার হয়েছিল। নরমপন্থীরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন, দুই লিগের সদস্যসংখ্যা বেড়ে যায়।

বেসান্ত এত জনপ্রিয়তা লাভ করেন যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কংগ্রেসে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের কথা বলেছিলেন, পরে অবশ্য এই অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বেসান্তের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ততা দেখা দিয়েছিল, অনেক শাখার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার পরিকল্পনা প্রকাশিত হলে বেসান্ত তার নিন্দা করেন, পরে তিনি মত পালটে একে সমর্থন করেন। গান্ধি হোমরুল সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে তাঁর আন্দোলন গড়ে তোলেন।

মূল্যায়ন : 

হোমরুল আন্দোলন একেবারে ব্যর্থ হয়েছিল বলা যায় না। দু’বছর ধরে (১৯১৬ ১৯১৮) এই আন্দোলন চলেছিল, সারাদেশে বহু কমিটি গঠন করে হোমরুল আন্দোলন পরিচালনা করা হয়েছিল। এই আন্দোলন খুব সংক্ষিপ্তভাবে জনগণের বোধগম্য ভাষায় জাতীয় দাবিকে তুলে ধরেছিল। সমগ্র জাতি কিছু পাবার আশা করেছিল, এই দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। রাজনীতিতে হোমরুল নতুন আন্দোলন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল। নতুন নতুন অঞ্চলে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। হোমরুল যে দ্বিধাগ্রস্ত পদক্ষেপ নিয়েছিল গান্ধিজি তাকে সুগঠিত রূপ দিয়ে সফল হন। এদের কাছ থেকে গান্ধিজি আন্দোলনের পদ্ধতি পেয়েছিলেন, গণ-আন্দোলনের রূপরেখা অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। নরমপন্থীদের আন্দোলন সীমিত রাখার দিন শেষ হয়েছিল (politics of studied limitation)। দাবি আদায়ের জন্য যে বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের প্রয়োজন তা বুঝতে নেতাদের দেরি হয়নি। হোমরুল আন্দোলনের ফলে ভারতীয় রাজনীতির চেহারা পালটে গিয়েছিল।

Leave a Comment