
ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব পরেছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্র কোরিয়ার উপরেও। উনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকে রাশিয়া, চীন এবং জাপানের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের কেন্দ্র কোরিয়া ১৯১০ থেকে জাপানের অধিকারে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মিত্রপক্ষ কোরিয়ার স্বাধীনতা প্রদানের বিষয়ে নানান আলাপ আলোচনা করে যদিও কোন সুস্পষ্ট গ্রহণযোগ্য মত এই বিষয়ে পাওয়া যায়নি। যুদ্ধান্তে পরাজিত জাপান উত্তর কোরিয়ার হাতে ক্ষমতা অর্পন করে এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর হাতে জাপান আত্মসমর্পন করে। ৩৮ ডিগ্রী অক্ষাংশ বরাবর উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সীমারেখা টানা হয়। ঐতিহাসিক পিটার কালভোকুরেশি লিখেছেন যে ৩৮ ডিগ্রী অক্ষাংশ প্রশাসনিক কারণে তৈরী বিভাজন রেখা হলেও শীঘ্রই এই রেখা বৃহৎ শক্তিগুলির টানাপোড়েনে রাজনৈতিক রেখায় পরিণত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ঠিক হয় যে জাতিপুঞ্জের বাহিনীর উপস্থিতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই কোরিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করা হবে, উত্তর কোরিয়া এই নির্বাচনের বিরোধিতা করে এবং এর ফলে দক্ষিণের সরকারকেই কোরিয়ার বৈধ সরকার রূপে ঘোষণা করা হয়। এই সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তর কোরিয়ার বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে এবং দখল নেয়। জাতিপুঞ্জের বাহিনীকে নেতৃত্বে দিয়ে মার্কিন সেনাপতি জেনারেল ম্যাক আর্থার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উত্তর কোরিয়ার বাহিণীকে চীন সীমান্ত পর্যন্ত পশ্চাদাপসরণে বাধ্য করে। এর ফলে চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষ অবলম্বন করলে কোরিয়ার রাজনীতি আরও জটীল হয়ে ওঠে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামরিক ব্যূহের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান ও অস্তিত্ব মার্কিন স্বার্থরক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোন মূল্যে উত্তর কোরিয়ার সম্প্রসারণকে রোধ করতে প্রয়াসী হয় এইভাবে কোরিয়াও হয়ে ওঠে ঠান্ডা যুদ্ধের রাজনৈতিক সংকটের অন্যতম কেন্দ্রে।
![]() |
General douglas mac arthur |
উত্তর কোরিয়ার বাহিনীর দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণকে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসাবে ভারত সমর্থন করেনি এবং ১৯৫০’র জুন মাসে নিরাপত্তা পরিষদের ২৫ জন সদস্য যখন ৩৮ ডিগ্রী অক্ষাংশ অতিক্রমকারী উত্তর কোরিয়কে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করে, তখন ভারত সেই প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষ অবলম্বন করে। ২৭ শে জুন আক্রমণকারী রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যখন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব নেওয়া হয়, তখন ভারত সেই প্রস্তাবকেও সমর্থন করে।
ভারতের সংসদে অবশ্য পশ্চিমী শক্তি ঘেষা এই অবস্থানের সমালোচনা শুরু হয় এবং প্রধানমন্ত্রী নেহেরু যুক্তি দেন যে এশিয়ায় শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যেই ভারত কেবল উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসনের বিপক্ষে পশ্চিমী শক্তিবর্গের অবস্থানকে সমর্থন করেছে, পাশ্চাত্য দেশসমূহের সঙ্গে কোন আদর্শগত বা নৈতিক বন্ধন বা নৈকট্য গড়ে তোলেনি।
কোরিয়া সংকটে ভারতের ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত, কোরিয়ার সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ১৩ই জুলাই নেহেরু, স্তালিন ও ডীন এ্যাকিসনের কাছে প্রেরিত বার্তায় বলেন যে কমিউনিস্ট চীনের প্রতিনিধিকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য করা হোক এবং চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া আলোচনার মাধ্যমে কোরিয়া যুদ্ধের সমাধান করুক নেহেরুর এই প্রস্তাব স্তালিন মেনে নিলেও ডীন এ্যাকিসন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
![]() |
Korean War |
অক্টোবরের প্রথমদিকে যখন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বাহিনী উত্তর কোরিয়ার বাহিনীকে ৩৮ ডিগ্রী অক্ষাংশের উপরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে তখন ভারত জাতিপুঞ্জের ভূমিকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। নেহেরু এই সময় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে ন্যাটোর বাহিনীর মত ব্যবহার করতে চাইছে এবং চীনকে পরাজিত করার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।
অন্যদিকে, ৩৮ ডিগ্রী অক্ষাংশ বরাবর চীনের বাহিনীর ক্রম আগ্রাসনকেও নেহেরু প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন। ভারতের বিরোধিতা সত্ত্বেও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীনের আগ্রাসনের নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত ও অনুমোদিত হয়। এই পর্বে চীন সম্পর্কে ভারতের সহানুভূতিশীল বিবৃতির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সমালোচনা করে। আবার অন্যদিকে পশ্চিমী অবস্থানকে সমর্থন করার কারণে পিকিং ও মস্কোতেও ভারত মর্যাদা হারায়। এই পর্বে চীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় এবং ভারত কোরীয় কূটনীতি থেকে সরে আসে।
যুদ্ধবিরতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা বিশেষ এগোয়নি, জাতিপুঞ্জের বাহিনী চেয়েছিল কোরীয় যুদ্ধবন্দীরা যদি স্বেচ্ছায় কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রনে ফিরে যেতে চায় তো যেতে পারে, অন্যদিকে চীন এবং উত্তর কোরিয়া বলেছিল যে যুদ্ধবন্দীদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে ধরে রাখা হয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়া উভয় পক্ষই ভারতকে সক্রিয় মধ্যস্থতার জন্য আবেদন জানাতে থাকে। কোরিয়ার বিষয়ে ভারতীয় প্রতিনিধিদল তৈরী হয় যার প্রধান হন কৃষ্ণমেনন। কৃষ্ণমেনন প্রস্তাব প্রণনয়নের আগে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের মতামত গ্রহণ করেন। ভারতীয় প্রতিনিধিদল প্রস্তাবে বলে যে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহ নিয়ে গঠিত একটি কমিশন অ-জবরদস্তিমূলক প্রত্যাবাসন কার্যকরী করবে।
মূল্যায়ন
জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় ৩রা ডিসেম্বর ভারতের প্রস্তাব পাস হয় কিন্তু কমিউনিস্ট শিবিরের বিরোধিতায় এই প্রস্তাব কার্যকরী হয়নি। পরে ১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যুর পর চীনের রাষ্ট্রপ্রধান চৌ এন লাই ৩রা ডিসেম্বরের প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি সমঝোতায় আসেন। ভারতের নেতৃত্বে নিরপেক্ষ জাতিসমূহের প্রত্যাবাসন কমিশন গঠিত হয় (Neutral nations Repatriation Commission) ভারত এই কমিশনের চেয়ারম্যান হয়। ভারতীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে কোরীয় যুদ্ধবন্দীরা স্বাধীনভাবে তাদের অবস্থান ঠিক করবে এরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু বিপুল পরিমাণ যুদ্ধবন্দীর সাক্ষাত নেওয়া অসম্ভব বুঝে ভারত ঠিক করে যে যুদ্ধবন্দীদের যে দেশ তাদের গ্রেফতার করেছে তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ভারতের এই সিদ্ধান্ত প্রথমে সমালোচিত হলেও পরে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান এবং যুদ্ধবন্দী প্রত্যার্পনের ক্ষেত্রে সাহসী নীতি প্রশংসিত হয়। এইভাবে, কোরিয়া সংকটে ভারত বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
tlovertonet
It is really a nice and useful piece of information. I’m glad that you shared this helpful information with us. Please keep us informed like this. Thank you for sharing.