জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে জহরলাল নেহেরুর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। ১৯৪৬ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর নেহেরু ভারতকে সকল প্রকার সামরিক ও রাজনৈতিক জোটের বাইরে রাখার পক্ষে মতামত দেন। পরে ১৯৪৯ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এশিয়ার সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত রাষ্ট্র গুলির একটি সম্মেলনে ঐ দেশগুলিকে নিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের পরিকাঠামোর মধ্যেই একটি কার্যকর মঞ্চ গঠনের প্রস্তাব রাখা হয় নেহেরু এই সম্মেলনে বলেছিলেন ‘All countries of Asia have to meet together on an equal basis in a common task and endeavour’।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেহেরুর ভূমিকা
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল ( জওহরলাল ) নেহরুকে জোটনিরপেক্ষ নীতি বা আন্দোলনের জনক বা উদ্ভাবক বলে মনে করা হয়। তিনি ঘোষণা করেন যে, ভারত সকল জোট ও সামরিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বাইরে থাকবে ভারতের স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ঘোষণা করেন যে, ভারত সকল জোট ও সামরিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বাইরে থাকবে এবং সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করবে। স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় গণপরিষদেও তিনি এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন। নেহেরু বিশ্বাস করতেন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

দেশীয় নেতাদের মধ্যে, বিশেষ করে কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে জোট নিরপেক্ষতার নীতির প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করে নেহেরু পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে শান্তি ও সৌভাতৃত্ব রক্ষা, বিশ্ব জুড়ে সকল দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও সহাবস্থান, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দেশগুলির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, বর্ণবৈষম্যবাদের বিরোধিতা ইত্যাদি সমন্বয়ে একটি গতিশীল ও ইতিবাচক পররাষ্ট্র বিষয়ক অবস্থানের কথা বলেন। ( নেহেরু কর্তৃক প্রেরিত ১৯৫০ সালের ১৫ই জুলাই মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে প্রেরিত পত্র এবং ১৯৫৪ সালে কংগ্রেসের আবাদী সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ ) । ১৯৫১ সালের অক্টোবরে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে ভারতকে সামরিক অন্যান্য জোটবদ্ধ রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার নীতি ঘোষিত হয়।
১৯৫৪’ র এপ্রিল মাসে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ভারতে আসেন এবং ২১ শে এপ্রিল ভারত চীন পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য পাঁচটি সূত্র বিশিষ্ট নীতি বা পঞ্চশীল গৃহীত হয় ১) প্রত্যেকের আঞ্চলিক অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি মর্যাদাবোধ, ২) পরস্পরের বিরুদ্ধে আগ্রাসন থেমে মুক্ত থাকা, ৩) অন্যের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, ৪) সমমর্যাদা এবং ৫) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। পৃথক রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও চীন এবং ভারত সহযোগিতা ও সম্প্রীতির যে নিদর্শন স্থাপন করেছিল তাকে মূলধন করে নেহেরু এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথভাবে জোট নিরপেক্ষ কূটনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হলেন।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে জহরলাল নেহেরুর ভূমিকা কেবল তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি ১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে এশিয়া ও আফ্রিকার নেতারা মিলিত হন। এই সম্মেলনে এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি দেশ যোগদান করে। সম্মেলনে বর্ণবৈষম্যের অবসান, ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি, পারমাণবিক অস্ত্র-পরীক্ষা ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ প্রভৃতি বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ভারত এই সম্মেলনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন , এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ছিলেন এই সম্মেলনের মধ্যমগি। বান্দুং সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা করে।

১৯৬১ সালে জুন মাসে মিশরের কায়রোর জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির সম্মেলনে এশিয়া ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার ২১ টি রাষ্ট্র যোগদান করে। কায়রোর সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী 1961 খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড এর অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলি প্রথম শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের ২৫ টি দেশ যোগদান করে।
সর্বোপরি, জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলি বেলগ্রেড শীর্ষ সম্মেলনের পর ১৯৬৪ সালে কায়রো , ১৯৭০ লুসাকা , ১৯৭৩ সালে আলজিয়াস , ১৯৭৬ কলম্বো, ১৯৭৯ সালে সাভানা , ১৯৮৩ সালে দিল্লি , ১৯৮৬ সালে কায়রো , ১৯৮৯ সালে বেলগ্রেড , এবং ১৯৯২ সালে মার্কাতায় জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলি শীর্ষ সম্মেলনে বসে।
সুতরাং বলা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর উদ্যোগে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৪ সালে তার মৃত্যুর পর এই আন্দোলনের গতি প্রকৃতি কিছুটা সীমিত হয়ে পড়েছিল। এই সময় আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল সত্য কিন্তু এই আন্দোলনের সমর্থনকারী দেশের সংখ্যা যে বৃদ্ধি পেয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, এবং এই নীতির আদর্শ এখনো বহু উন্নয়নশীল দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে বিশেষ করে স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও সার্বভৌম সিদ্ধান্তের প্রশ্নে।