মথুরা শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর। মথুরা শিল্পের বৈশিষ্ট্য লেখ।
ভূমিকাঃ
সমৃদ্ধিশালী নগরী হিসাবে মথুরার খ্যাতি বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিরাজমান ছিল। কতকগুলি বাণিজ্যপথের সংযোগস্থল হওয়ায় অর্থনৈতিক দিক থেকে মথুরা ছিল সমৃদ্ধ। শিল্পেরও সেখানে বিকাশ ঘটেছিল অভাবনীয়ভাবে। মথুরা ভাস্কর্য শিল্প বিকশিত হয়েছিল কুষাণ আমলে, যদিও এর সূচনাকাল অনেক আগেই। মথুরা ছাড়াও এই শিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেছে পার্শ্ববর্তী সারনাথ, সাহেত-মাহেত (শ্রাবস্তী) এবং কোসাম (কৌশাম্বী)-এ। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কণিষ্কের সময় থেকেই মথুরার শিল্পীদের অভাবনীয় দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
মথুরা শিল্পের বৈশিষ্ট্যঃ
1) মথুরা শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সারনাথ যাদুঘরে রাখা কণিষ্কের রাজত্বের প্রথমদিকে নির্মিত দণ্ডায়মান বোধিসত্ত্ব মূর্তি গুলি। উচ্চতা দশ ফুট এবং প্রশস্ত তিন ফুট। এই মূর্তিটিতে শাক্যমুনি বা বুদ্ধের পা দুটি দৃঢ়ভাবে রক্ষিত বা দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর ডান হাত অভয় মুদ্রায় স্কন্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত, বাম হাতটি নিতম্বের ওপর স্থাপিত এবং শরীরের উর্ধ্বাঙ্গের পোশাক ঐ হাত দিয়েই ধরা আছে। ডান স্কন্ধ আবরণহীন, মূর্তিটির দু’পায়ের মাঝখানে একটি সিংহ মূর্তি দেখা যায়।
2) মথুরা ভাস্কর্য শিল্পের বোধিসত্ত্ব মূর্তির কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। মূর্তিগুলির অঙ্গ সৌষ্ঠবে পার্থিব শক্তির বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় বিশেষভাবে। অপার্থিব কোনো ধারণা এগুলির মধ্যে অনুপস্থিত। মূর্তিগুলির পরিচয় দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রতেকটি মূর্তি দণ্ডায়মান। সাধারণভাবে এগুলি গোলাকার, সমস্ত মূর্তিগুলি সামনাসামনি অবস্থিত। মূর্তিগুলি মস্তক মুণ্ডিত ও গুম্ফহীন। এগুলির কপালে কোনো ওড়না নেই। ঊর্ধ্বাঙ্গ অংশত আবৃত। ডান হাত অভয়মুদ্রায় উত্থান ভঙ্গিতে অবস্থিত এবং বাম হাত ঊরুর ওপরে রাখা। বক্ষ সামনের দিকে প্রলম্বিত, স্কন্ধগুলি প্রশস্ত, যা অফুরন্ত উৎসাহ ও শক্তির ইঙ্গিত দেয়। সর্বোপরি, চক্ষুদ্বয় উন্মীলিত এবং স্মিত হাসিসম্পন্ন মুখ।
3) মথুরা শিল্প ছিল ভারতীয় ভাবধারা পুষ্ট। এখানের বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণ সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে উদ্ভাসিত।
4) জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তি ছাড়াও মথুরার জৈন মন্দিরে অর্থৎদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত ‘আয়গ-পত্ত” বা ‘নিবেদন ফলক’-গুলির কথাও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। অর্থৎদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ফলকগুলি নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় রীতি অনুযায়ী।
5) মথুরা শিল্পের মধ্যে ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা প্রতিফলিত হয়ে ওঠে মথুরা ও এর সংলগ্ন এলাকায় বেশ কিছু স্তম্ভ ও স্তম্ভের নিম্নাংশের সম্মুখভাগে উৎকীর্ণ ভাস্কর্য থেকে।
6) মথুরা শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল নারীমূর্তি নির্মাণ ও তার রূপকল্পনাকে তুলে ধরতে মথুরার শিল্পীরা ছিল বেশ পারদর্শী। মূর্তিগুলির রূপকল্পনায় নারীদেহের যৌন আবেদন বেশ স্পষ্ট। মূর্তিগুলিতে একদিকে যেমন লাবণ্য ও নমনীয়তা স্থান পেয়েছে অপর দিকে তেমনি কামনার আবেদনও বিরাজমান। অনেক ক্ষেত্রে শিল্পের বিষয়বস্তু হিসাবে কোনো বিহার বা মন্দিরের ধনী পৃষ্ঠপোষকরাও বিবেচিত হয়েছিলেন।
7) ভাস্কর্য নিদর্শনগুলির মধ্যে মাত্র কয়েকটি বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব মূর্তি। এছাড়াও কিছু পুরুষ মূর্তি দেখা যায়। তবে বেশিরভাগই হল নগ্ন ও অর্ধ-নগ্ন নারীমূর্তি।
8) মথুরা শিল্পের মূর্তিগুলি সম্ভবত যক্ষিণী অথবা বৃক্ষকা অথবা অপ্সরাদের। এদের অবস্থান কামদ (যৌন) ভঙ্গিতে। এই মূর্তিগুলির মধ্যে সম্ভবত উদ্ভাবনী বা উর্বরা শক্তির ইঙ্গিত নিহিত। এই ভাস্কর্য নিদর্শনগুলির সঙ্গে যেমন শুঙ্গ-কুষাণ যুগে পোড়ামাটির নিদর্শনগুলির ঘনিষ্ঠ যোগ আছে, তেমনি এগুলি অবস্থান করছে ভারত, বুদ্ধগয়া, ও সাঁচীর যক্ষিণী ও বৃক্ষকাগুলির ন্যায় একই সরলরেখায়।