বনজ সম্পদ কাকে বলে? বনজ সম্পদের ব্যবহারগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করো।
বনজ সম্পদ কাকে বলে?
বনজ সম্পদ (Forest resources) : বনজ সম্পদ হল প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। বনজ সম্পদ থেকে আমরা গৃহনির্মাণের সাজ সরঞ্জাম, জ্বালানি, নানা ধরনের গাছ, ওষুধ, আঠা ও ধুনো জাতীয় পদার্থ পেয়ে থাকি ।
বনজ সম্পদের ব্যবহার (Uses of forest resources) :
1. কাঠ (wood) :
বনজ সম্পদ হিসাবে সর্বাধিক ব্যবহৃত দ্রব্যটি হল কাঠ। প্রকৃতি অনুসারে কাঠ দুধরনের হয়ে থাকে। যথা—নরম কাঠ এবং শক্ত কাঠ । শক্ত কাঠ উৎপাদনকারী কয়েকটি অতি পরিচিত উদ্ভিদ হল –শাল, সেগুন, জারুল, লগউড্, মেহগিনি, আবলুস, শিমূল, আয়রণ উড, দেবদারু প্রভৃতি। নরম কাঠ উৎপাদনকারী কয়েকটি উদ্ভিদ হল – পপুলার, পাইনাস, সাইকাস, সেড্রাস পাইসিয়া, ফার, বালসাম প্রভৃতি। গৃহনির্মাণ, আসবাব তৈরি, বৈদ্যুতিক খুঁটি নির্মাণ এবং রেলের স্লীপার তৈরিতে শক্ত কাঠ ব্যবহৃত হয়। অপরপক্ষে কাঠ বোর্ড, নিউজ প্রিন্ট তৈরিতে নরম কাঠ ব্যবহৃত হয়। 2. তৃণ, বাঁশ এবং বেত (Grasses, Bamboos and Canes) : তৃণভূমি (Grassland) এবং অরণ্য (Forest) থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির তৃণ গবাদি পশুর খাদ্য (Fodder), গ্রামাঞ্চলে মাটির বাড়ির ছাদ নির্মাণ, কাগজ তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও খসখস ও বেতের চেয়ার টেবিল তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।
3. ওষুধ (Medicine) :
বনজ সম্পদের ব্যবহার হিসাবে অন্যতম দ্রব্যটি হল ওষুধ।বিভিন্ন প্রকার ঔষধ উৎপাদনকারী উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত অ্যালকালয়েড বা উপক্ষার, ইউজিনল জাতীয় যৌগ এবং আইসোপ্রিনয়েড যৌগ ওষুধ প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।
4. মশলা (Spices) :
অরণ্য থেকে প্রাপ্ত প্রধান মশলা উৎপাদনকারী উদ্ভিদগুলি হল—দারুচিনি, বড় এলাচ, ছোট এলাচ প্রভৃতি।
5. পাতা (Leaf) :
শাল গাছের পাতা ছাঁছে ফেলে থালা, বাটি প্রস্তুত করা হয়। এছাড়াও কেন্দুগাছের পাতা বিড়ি পাতা হিসাবে বিড়ি তৈরিতে কাজে লাগে। রান্নায় সুগন্ধী পাতা হিসাবে তেজপাতা ব্যবহার করা হয়।
6. ট্যানিন ও রং (Tannin and Dyes) :
আমলকী, বহেরা, হরিতকী, ওক, হেমলক, আখরোট প্রভৃতি উদ্ভিদের দেহ নিঃসৃত রস এবং অ্যাভারাম ও বাবলার পুষ্প থেকে ট্যানিন সংগ্রহ করা হয়। ট্যানিন কাঁচা চামড়া পাকা করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
7. তেল (Oil) :
চন্দন, ইউক্যালিপ্টাস, লেমন গ্রাস, সিট্রোনেল্লা নামক উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত তেল সাবান, ফিনাইল, ওষুধ ও অন্যান্য প্রসাধন সামগ্রী প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।
৪. আঠা ও রেসিন (Gums and resin) :
স্টারকুলেসী (Sterculaceae) এবং লেগুমিনোসী (Leguminosae) গোত্রভুক্ত কয়েকপ্রকার উদ্ভিদের বাকল থেকে আঠা পাওয়া যায়। এই আঠা বয়ন শিল্পে, খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতিতে, দাঁতের মাজন ও সিগারেট প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। সকল প্রকার পাইন উদ্ভিদ থেকে রেসিন পাওয়া গেলেও কেবলমাত্র চীর পাইন (Pimus roxburghi) থেকেই রেসিন সংগ্রহ করা হয়। রেসিন প্রধানত বার্ণিশ শিল্পে, কৃত্রিম কর্পূর প্রস্তুত, মোম, রঙ, সাবান, ফিনাইল প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।
9. তত্ত্ব (Fibre) :
কয়েক প্রকার উদ্ভিদের স্ক্লেরেনকাইমা তত্ত্ব, জাইলেম তন্তু এবং ফ্লোয়েম তত্ত্ব দড়ি, গদি ও বালিশ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
10. খাদ্য দ্রব্য (Edible Products) :
অরণ্য থেকে ফল, ফুল, তৈলবীজ, মাশরুম, তেঁতুল, আমলকী, খেজুর, মহুয়া প্রভৃতি পাওয়া যায়। অরণ্য থেকে প্রাপ্ত প্রধান প্রধান ফলগুলি হল – আম, জাম, বেল, কয়েত বেল, খেজুর, তাল, আমলকী, মহুয়া, পিয়াল, ক্যাদ প্রভৃতি। এছাড়াও নারকেল, আখরোট, চীনাবাদাম প্রভৃতি তৈলবীজ পাওয়া যায়। অরণ্য থেকে মাশরুম হিসাবে দুর্গাছাতু (Agaricus bisporous), কুরকুরে ছাতু (Lycoperdon Sp), পোয়াল ছাতু (Volvarella Sp) প্রভৃতি পাওয়া যায়, যেগুলি খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
11. প্রাণীজ দ্রব্য (Animal Products) :
অরণ্য থেকে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য প্রাণীজ দ্রব্যগুলি হল— লাক্ষা, মধু, মোম, রেশম, শিং, হাতীর দাঁত, হরিণের শিং প্রভৃতি। লাক্ষা বহুল ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়— ওষুধ উৎপাদনে, বিদ্যুৎশিল্পের অন্তরক তৈরীতে, রঙ ও গালা তৈরীতে, কাঠের পালিশ করতে এবং রেশম পালিশ করতে। মোম এবং মধু বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রকার বনজ দ্রব্যগুলি সেই দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বর্তমানে প্রায় 40 লক্ষ মানুষ আমাদের দেশে অরণ্যভিত্তিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের দেশের সরকারি আয়ের প্রায় 3% বনজ সম্পদ থেকেই হয়ে থাকে।