অজন্তা গুহা চিত্রের বৈশিষ্ট্য ।
১) অজন্তা গুহা চিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল রঙের ব্যবহার। রঙ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগে পরিণত পর্বে অজন্তায় অনেক পরিবর্তন ঘটে। রাজা-রানীর গায়ের রঙ অনেক স্থানে হালকা বেগুনি, হালকা হলদে এবং কোথাও বা শুধুমাত্র হালকা লাল রঙই ব্যবহার করা হয়েছে। দাসদাসী বা নিম্নশ্রেণির লোকের গায়ের রঙ ‘ইন্ডিয়ান রেড’ দিয়ে আঁকা। ফিকে ও গাঢ় নীল রঙের ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। দাসদাসীদের বাহারে লাল-নীল ডোরাকাটা কাপড়, তাদের হাঁটু অবধি পরিধানের কাপড়ের সামনে ও দু’পাশে আলাদা কাপড়ের কোঁচা, বিচিত্র মেখলা বা কোমর-বন্ধ অঙ্কিত হয়েছে। হাতে, পায়ে, গলায়, কানে ও মাথায় নানাধরনের অলঙ্কার আঁকা হয়েছে। কিন্তু রাজারানীদের অলঙ্কারের বাহুল্য অপেক্ষাকৃত কম।
২) রাজাদের অজন্তার ছয়টি গুহায় যে ছবিগুলি রয়েছে তার মধ্যে সেযুগের ঘরবাড়ি, রাজসভা, রাজ অন্তঃপুর, রাজা-রানী, দাস-দাসী, সৈন্য-সামন্ত, সভাসদ ও সাধু-সন্ন্যাসীদের বিচিত্র কাপড়-চোপড়, নানা আসবাবপত্র, প্রসাধনের সামগ্রী, যুদ্ধবিগ্রহের উপকরণ, দোকান-পসার, যানবাহন, সমুদ্রযাত্রা, সাধারণ মানুষ প্রভৃতি জাগতিক জীবনের সবকিছুর সন্ধান পায়। এককথায়, প্রাচীন ভারতের সর্বস্তরের মানুষের জীবনযাত্রার চিত্রপুস্তক হল অজন্তার চিত্রাবলী।
৩) অজন্তায় নানাভঙ্গীতে বসা ও দাঁড়ানো বহু নরনারীর চিত্র আছে, কিন্তু কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল নেই। ছবিগুলি আঁকতে গিয়ে শিল্পীরা নানা নতুন ভঙ্গী ও ব্যঞ্জনার উদ্ভাবন করেছেন। বিশেষত বসা মূর্তিগুলি এতটাই সহজ ও স্বাভাবিক এবং এমন আলতোভাবে বসে আছে যে, শিল্পীরা অবলীলাক্রমে মাত্র কয়েকটি রেখার সাহায্যেই এগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।
৪) অজন্তা গুহা চিত্রের আর এক বৈশিষ্ট্য হল সুন্দর ছবিগুলো। অজন্তার সবচেয়ে সুন্দর ছবির নিদর্শন গুলি পাওয়া গেছে ১৬, ১৭ ও ১ নং গুহার কিছু অংশে। এইসময়েই রাজা মহারাজাদের জীবনযাত্রা, রাজসভা, যুদ্ধযাত্রা, সমুদ্রযাত্রা ও নৃত্যগীতের ছবি আঁকা শুরু হয়।
৫) অজন্তার চিত্রগুলি যদিও ধর্মীয় চিত্র, তথাপি ভোগবিলাসের এই ছবিগুলিতে শিল্পীরা যে সংযম ও শালীনতার ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন তা তাদের উচ্চমানের শিল্প দক্ষতার পরিচয় বহন করে। মহারাষ্ট্রের অজন্তায় ২৯টি গুহার (বিশদের জন্য গুহা-স্থাপত্য দেখ) মধ্যে ২৩টি গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের বাকি পাঁচটি খ্রিস্ট-পূর্ব শতাব্দীর।
৬) অজন্তার ১৯ ও ৬ নং গুহার চৈত্যগৃহ ১৯ নং গুহা-মন্দিরের বাইরের দিকের মধ্যভাগে পদ্মের পাঁপড়ির মত আকৃতির চৈত্য-গবাক্ষটি এই গুহার সমস্ত স্থাপত্য পরিকল্পনাকে একটি কেন্দ্রানুগ ভারসাম্য প্রদান করেছে। চৈত্য-গবাশ্মের সরল ও সাবলীল রূপরেখা; উপরে, নীচেও দু’পাশে যেসব ভাস্কর্য অলঙ্করণ আছেতা এটির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে। গবাক্ষের দু’পাশে দাঁড়ানো যক্ষ মূর্তিদুটি তাদের বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গী ও দৃঢ় পেশীযুক্ত গুরুভার দেহকাল্ডের নিখুঁত রূপায়ণে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর তলদেশে স্থাপত্য শিল্পসমন্বিত ছোটো ছোটো চৈত্য-গবাক্ষ দিয়ে দু’টি মসৃণ বন্ধনী আছে। এরও নীচের দিকে ঠিক মাঝ বরাবর চারটি স্তম্ভের উপরে একটি ছোটো মন্ডপ ১৯ নং চৈত্যগৃহের (গুহা) প্রবেশদ্বারটিকে সুসজ্জিত রেখেছে। চৈত্যগৃহের সামনের দিকের অন্যান্য অংশ বুদ্ধমূর্তি, বিকশিত পদ্ম ও ঢেউ খেলানো রেখার দ্বারা সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত।
৭) অজন্তার ১৬ নং গুহার ভিতরে একটি সুন্দর স্তূপের উপর বুদ্ধের একটি অপূর্ব মূর্তি রয়েছে। এর উপরের ভাগ গোল এবং বুদ্ধমুর্তিটির দু’পাশে দু’টি স্তম্ভ। মধ্যভাগটিও গোলাকার মন্দিরের মত। অলঙ্কৃত স্তর বা ধাপগুলি বড় থেকে মাঝ বরাবর ছোটো হয়ে নীচের দিকে আবার বড় হয়ে গেছে। অজন্তার ১৬ নং গুহা (চৈত্যগৃহটি) কিছুকাল পরে নির্মিত হয়েছিল।
৮) অজন্তায় ১৬ ও ১৯ নং গুহা ছাড়া বাকি গুহাগুলিতে সংঘারাম ও বিহার নির্মিত হয়েছিল। এর মধ্যে প্রায় ২০টি গুপ্তোত্তর যুগের। এগুলির মধ্যে আবার ১১, ১২, ১৩ নং গুহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অজন্তার প্রাচীনতম বিহারটি ১১ নং। এর কেন্দ্রীয় হলঘরে চারটি স্তম্ভ আছে, যা প্রমাণ করে ছাদকে ধরে রাখতে স্তম্ভগুলি নির্মিত হয়েছিল ভোজত্তার চার নং গুহার হলঘরটিও বেশ বড় আকারের। এর আয়তন ৮৭ বর্গফুট। এই গুহায় ২৮টি স্তম্ভ আছে। অজন্তার বিহারগুলির মধ্যে স্বাভাবিক পাথর থেকে খোদাই করে স্তম্ভগুলির ব্যবহারই এযুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই স্তম্ভগুলি নানাধরনের লতাপাতা, ঘর, আলঙ্কারিক প্রস্ফুটিত পদ্ম ও শূণ্যে ভাসমান গন্ধর্ব মূর্তিতে সুসজ্জিত। পরবর্তী যুগে এই গুহাগুলির অনেকগুলির মধ্যেই বুদ্ধের মূর্তির জন্য গর্ভগৃহের মত কক্ষ দেখা যায়।