StudyMamu

1911 সালে চীনে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবে সান ইয়াৎ সেনের ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা কর

July 7, 2022

1911 সালে চীনে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবে সান ইয়াৎ সেনের ভূমিকা সংক্ষেপে আলোচনা কর।

১৯১১ সালে চীনে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠনে সান ইয়াৎ সেন-এর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। বস্তুত তিনি চীনকে বিদেশী মাঞ্চু অপশাসনের কবল থেকে মুক্ত করে বিপ্লবী পথে পরিচালিত করেন। কিন্তু সান-এর এই বিপ্লবী আন্দোলনের ফলে চীনের সাধারণ জনগণ যথার্থ প্রজাতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। তাই বলা যায়, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব চীনে মাঞ্চু বংশের পতন ঘটালেও এই বিপ্লব শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। চীনের সাধারণ জনগণ বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে প্রায় গোড়া থেকেই এই বিপ্লব বিপথে যেতে শুরু করেছিল।

সান ইয়াৎ সেন

সান তাঁর মতাদর্শকে পুরোপুরি সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রূপ দিতে পারেননি। যেখানে সংগ্রামের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল সামন্তপ্রভুদের উচ্ছেদের সাথে সাথে সমগ্র সামন্তপ্রথার বিলোপসাধন, সেখানে তিনি শুধু মাঞ্চু অভিজাতদের হাত থেকে ক্ষমতা দখলের কথা বলেছিলেন। শুধু তাই নয়, গোড়ার দিকে তাঁর চিন্তায় মাঞ্চু শাসনের বিরোধিতা এত প্রাধান্য পেয়েছিল যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যে চীনের চরম শত্রু তা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। তাঁর জনগণের তিন নীতির মধ্যে জনগণের জীবিকা বা সমাজতন্ত্র ঠিক কি তা অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়নি।

সানের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ চীনের প্রাচীন আদর্শ “লাঙ্গল যার, জমি তার (“Land to the tiller”)-এর আদর্শ এবং তাইপিংদের ভূমি বণ্টনের নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সান মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে চীনের কৃষকেরা যেমন সামন্ততান্ত্রিক শোষণ-মুক্ত হবে তেমনি পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের উত্থান রোধ করা সম্ভব হবে। বাস্তবে তা করা সম্ভব হয়নি, কারণ আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে। তাঁরা তাঁদের বুর্জোয়া মানসিকতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি।

চীনা কমিউনিস্টদের মতে বিপ্লবী নেতাদের শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতি অবজ্ঞার মনোভাব প্রথম থেকেই বিপ্লবের ভিতকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এর ফলে তাঁরা সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। চীনের কৃষক সমাজ সামন্ততন্ত্রের অধীনে শোষিত ও নিপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ কৃষক সম্প্রদায়ের মতো পরিবর্তনকারী শক্তিগুলিকে সঠিকভাবে বিপ্লবের কাজে ব্যবহার করেননি। লক্ষ্যণীয় যে সান তাঁর বিপ্লবী ইস্তাহারে  উদার ধর্মনিরপেক্ষ বিকাশশীল চীন গঠনের কথা বললেও শ্রমিক ও কৃষক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের কোনও চেষ্টা করেননি। বিপ্লবের নেতাদের মধ্যেও মতাদর্শগত কোনও ঐক্য ছিল না, ছিল না তাঁদের শ্রেণি চরিত্রে কোনও সামঞ্জস্য।

তুং-মেং হুইয়ের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ঐ দলের মধ্যে ভবিষ্যতে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। দলীয় নেতা ও সমর্থকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বুর্জোয়া, আধা-বুর্জোয়া এবং মাঞ্চুবিরোধী জমিদার শ্রেণির লোক। বিপ্লবী নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ চেয়েছিলেন মাঞ্চু শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে, আবার কেউ কেউ শুধু মাঞ্চু শাসনের উচ্ছেদ ঘটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউ সানের কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের আদর্শ গ্রহণ করেননি। মাঞ্চু বংশের উচ্ছেদ ঘটানোর . বিষয়ে তাঁরা সকলে একমত ছিলেন। কিন্তু শুধু রাজবংশের উচ্ছেদ ঘটিয়ে যে দেশের সার্বিক বিকাশ ও পরিবর্তন ঘটানো যায় না তা তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে জনগণের জীবিকার সংস্থান করার কথা তাঁরা ভুলে যান। সান চেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের আদর্শ ‘জনগণের তিন নীতি’কে বাস্তবায়িত করতে। কিন্তু তাঁর প্রথম নীতি ‘জনগণের জাতীয়তাবাদ’ সাফল্যমণ্ডিত হলেও বাকি দুই নীতি জনগণের অধিকার বা গণতন্ত্র এবং জনগণের জীবিকা অধরা থেকে যায়। বাস্তবিকই চীনে না হয়েছিল কোনো প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, না হয়েছিল জনগণের আর্থিক উন্নয়ন। মার্কসবাদীরা তাই সানের নেতৃত্বে সংগঠিত এই বিপ্লবকে “বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব” আখ্যা দিয়েছেন।

সানের এই বিপ্লবী আন্দোলন চীনে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ এই আন্দোলনে গণ সমর্থনের অভাব ছিল এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রকৃত বিপ্লবীদের হাত থেকে প্রতিবিপ্লবী এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে চলে গিয়েছিল। বিপ্লবীদের মনে রাখা উচিত ছিল যে সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে গেলে তাঁদের ব্যাপক গণসমর্থনের প্রয়োজন। সমকালীন চীনের শ্রমিক ও কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ব্যাপক বৈপ্লবিক সম্ভাবনা ছিল তা বিপ্লবীরা কাজে লাগাবার কোনও প্রচেষ্টাই করেননি। বিপ্লবী নেতাদের বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গিই এই অদুরদর্শীতার প্রধান কারণ ছিল। এর ফলে গণভিত্তিহীন বুর্জোয়া নেতৃবৃন্দের পক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের চূড়ান্ত মুহূর্তে দেশি ও বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবীদের সম্মিলিত চাপ প্রতিহত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

মতাদর্শগত ভিন্নতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতাও তাদের এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ। প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য মাঞ্চু শাসনের অবসান ঘটানোই যথেষ্ট নয়, এরজন্য প্রয়োজন জনগণের জীবিকার যথাযথ ব্যবস্থা করা যা তাঁরা করে উঠতে পারেননি। আন্দোলনের ভিতকে মজবুত করার পরিবর্তে বুর্জোয়া নেতারা সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোস করেছিলেন। এরফলে চীনে তখন কোনও প্রকৃত রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। বিপ্লবীদের মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে দলের মধ্যে বহু প্রতিবিপ্লবী ও রক্ষণশীল শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে যাঁরা বিপ্লবকে বিপথে চালিত করে এবং ভেতর থেকে বিপ্লবকে দুর্বল করে দেয়।

চীনের বেশ কিছু স্থানে শক্তিশালী বিপ্লবী নেতার অভাবে সেখানকার সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি অতি দ্রুত প্রাক্তন রাজকর্মচারী ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলদের হস্তগত হয়। যেমন, লি ইউয়ান-হুং-এর মতো মাঞ্চু সেনা অফিসার বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত না হয়েও হুপে প্রদেশের সামরিক নেতা হয়ে যান যারা পুরানো ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটাননি। 

হুনানের সামরিক ও অসামরিক প্রশাসনে কোনো পরিবর্তন না আনার ফলে রাজকর্মচারীদের মতো প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতেই ক্ষমতার রাশ থাকে যারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন। বিপ্লবের হাওয়া জোরদার দেখে তাঁরা ভোল বদল করেন। তাঁরা বিপ্লবের অনুকূলে প্রাদেশিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, কিন্তু তাদের শ্রেণিচরিত্র বদলায়নি। এইভাবে বিপ্লবের নামে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবিপ্লবীরা ক্ষমতা দখল করেছিল।

সামন্ততান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে আপোস করার ফলে উচ্যাং-এর অভ্যুত্থানের পর থেকেই বিভিন্ন চরিত্রের প্রতিবিপ্লবীরা দল দলে বিপ্লবীদের দলে ঢুকে পড়ে। প্রতিবিপ্লবী তথা রক্ষণশীলপন্থীরা চীনে আমূল পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন, তাঁরা চীনে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। সার্থক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী সান তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাধ্য হয়েছিলেন ইউয়ান শিকাই-য়ে মতো সুযোগসন্ধানী, স্বার্থান্বেষী বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে আপোস করতে, কারণ তিনি তাঁর নিজের দলের মধ্যেই তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থকের অভাব বোধ করেছিলেন। এই কারণে সান বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিতে।

১৯০৬ সাল থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে তুং-মেং হুই চীনের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার একটি বড়ো কারণ ছিল বিপ্লবের উদ্দেশ্যে জনসাধারণের সাহায্য না নেওয়া। অথচ বিপ্লবের উপাদান হিসেবে চীনের কৃষক ও শ্রমিক সম্প্রদায় ছিল যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। এই সময় এই দুই শ্রেণি অনেক ধর্মঘট, চালের দাঙ্গা এবং কর-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। চীনে শ্রমিক আন্দোলন সাংহাই, উহানের মতো কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। লক্ষণীয় যে চীনা পুঁজিবাদীদের একাংশ কখনো কখনো জনতার সঙ্গে যোগ দিয়ে বিদেশী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। কিন্তু শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের কৃষক-বিক্ষোভ ছিল অনেক ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে—হোনান, হুনান, হুপে, কিয়াংসি, কোয়াংসি কিয়াংসু, শানটুং প্রভৃতি প্রদেশে জনগণ খাদ্যের অভাব ও কর-বিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কিন্তু বিপ্লবীরা কৃষকদের এই বিক্ষোভকে বিপ্লবের হাতিয়ার করার কোনও চেষ্টা করেননি।

প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও সান ইয়াৎ সেন (Sun yat-sen)-কে প্রতি পদে ইউয়ান শি কাইয়ের মতো ক্ষমতালোভী, নীতিহীন ব্যক্তির সাথে আপোস করতে হয়েছে। কারণ ইউয়ান শি কাইয়ের সঙ্গে পাল্লা দেবার মতো সামরিক শক্তি সানের ছিল না। মাঞ্চু রাজশক্তির অপসারণের জন্য ইউয়ানের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যর্থ হবার জন্য বিদেশি শক্তিগুলির ভূমিকাও কম ছিল না। বিদেশি শক্তিগুলি কখনও চায়নি যে বিপ্লবীরা সফল হোক, কারণ তাদের ভয় ছিল যে চরমপন্থী বিপ্লবীরা তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবে। তাই তারা চীনের শাসনক্ষমতায় এমন একজন ব্যক্তিকে চেয়েছিল যাঁর বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা থাকলেও বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। এই বিদেশি শক্তির কূটনৈতিক ও আর্থিক সাহায্য নিয়েই ইউয়ান চীনে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯১২ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি শিশুসম্রাট পু-ঈকে সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য করা হয়। ১৩ই ফেব্রুয়ারি  সান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ইউয়ানের নাম প্রস্তাব করেন এই শর্তে যে নানকিং হবে প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। সান ভেবেছিলেন বিপ্লবীদের ঘাটি নানকিং-এ ইউয়ান রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করলে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। ধূর্ত ইউয়ান সানের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পিকিং, তিয়েনসিন, পাওতিং প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহ লাগিয়ে পিকিং-এ তাঁর অবস্থানকে বাধ্যতামূলক করেন। তাঁকে আর রাজধানী পরিবর্তন করতে হয়নি। ফলে ইউয়ানের উদ্দেশ্য সফল হয় সানের স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। এইভাবে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব চীনে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়। 

Share Post :

Leave a Comment