StudyMamu

বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে রামকিঙ্কর বেইজের অবদান

June 14, 2022

 

বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে রামকিঙ্কর বেইজের অবদান

অথবা,


রামকিঙ্কর বেইজের অবদান

অথবা,

ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে রামকিঙ্কর বেইজের অবদান



বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিল্পীদের মধ্যে রামকিংকর বেইজ একজন কিংবদন্তী শিল্পী ও ভাস্কর। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ১৯০৬ সালে তিনি বাঁকুড়া শহরের কাছে জন্মগ্রহণ করেন। আত্মস্থ এই শিল্পীর চিত্রবিদ্যার স্ফুরণ ঘটে বাল্যকালেই প্রতিকৃতি চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে। ভাস্কর্যের হাতেখড়িও তাঁর বাল্যকালেই। বাঁকুড়া টেরাকোটা শিল্পকর্মের অনুকৃতি অঙ্কন (Copy Painting)-র মধ্যেও ছোটোবেলা থেকে তাঁর শিল্পলিপ্সার পরিচয় পাওয়া যায়।




১৬ বছর বয়সে রামকিংকর শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। রবীন্দ্রনাথ নন্দলাল বসুকে রামকিংকরের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। নন্দলাল বসু ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হিসেবে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তিনি সানন্দে শিল্পশিক্ষা ও চর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন।




১৯২৫ সালে রামকিংকর বেইজ শান্তিনিকেতনে তাঁর ভাস্কর্য কাজের সাক্ষর রাখেন। ঐ বছরই ‘All India Art Exhibition-এ অংশগ্রহণ করে তিনি রৌপ্যপদক লাভ করেন। প্রসঙ্গত ঐ প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন তাঁরই শিল্পগুরু নন্দলাল বসু। ১৯২৯ সালে কলাভবন থেকে ভাস্কর্য বিষয়ে ডিপ্লোমা লাভ করার পর রামকিংকর স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেন। ভাস্কর হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ ছিল প্লাস্টার অফ্ প্যারিসে তৈরি ‘কচ ও দেবযানী’ (১৯৩০)। প্রসঙ্গত শান্তিনিকেতনে আগত দু’ই ইউরোপীয়ান ভাস্কর লিসা ভন্ পট ও মিলওয়ার্ড-র কাছে তিনি কিছুদিন ভাস্কর্যের বিষয়ে টেকনিক শেখার সুযোগ লাভ করেছিলেন।




১৯৩০ সালে রামকিংকর কলাভবনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এইসময় তিনি ‘কারুসংঘ’ নামে শিল্পী সদস্যদের এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৩০ সালের শেষদিকে তিনি কলাভবন ছেড়ে প্রথমে আসানসোল ও পরে দিল্লী মডার্ন স্কুলে যোগ দেন। ১৯৩৪ সালে রামকিংকর পুনরায় কলাভবনে ফিরে আসেন এবং স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই তাঁর শিল্পকর্মের প্রকৃত পর্ব শুরু হয়।




শান্তিনিকেতনে যোগদানের পরপরই তিনি প্রবীন ও নবীন শিল্পীদের নিয়ে ‘শ্যামলী’-র দেওয়ালে বিখ্যাত রিলিফের কাজটি সম্পন্ন করেন। ১৯৩৫ সালে ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘কৃষ্ণগোপিনী’ (রিলিফ ভাস্কর্য) এবং ‘সুজাতা’ (মুক্ত দণ্ডায়মান ভাস্কর্য) নামে তিনটি বিখ্যাত ভাস্কর্য তিনি সম্পন্ন করেন। ১৯৩৬ সালে রামকিংকর ছাত্রদের নিয়ে কলাভবনের পিছনের দেওয়ালে ভাস্কর্যের সূচনা করেন। এই কাজ শেষ হয় ১৯৩৭ সালে। এরপর তিনি ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেন। ‘Lady with dog’ এইসময়ে আঁকা তাঁর একটি বিখ্যাত তৈলচিত্র। ১৯৩৫-৪০ সময়কাল রামকিংকরের জীবনে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির কাল হিসেবে চিহ্নিত হয়। এইসময় ‘সাঁওতাল পরিবার’ (ভাস্কর্য, ১৯৪০), ‘পিকনিক’ (তৈলচিত্র, ১৯৩৮), ‘Head of a woman’ (ভাস্কর্য, ১৯৩৯)-র মত ভাস্কর্য ও চিত্র ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে তিনি কিছু যুদ্ধবিরোধী চিত্রকর্ম অঙ্কন করেন। বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ‘Harvest’ নামক কংক্রিটেরকাস্টিং-র কাজটি করেছিলেন। ১৯৪৪-৪৬-এ বাংলার বাইরে দিল্লী, কাঠমাণ্ডু প্রভৃতি স্থানে তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয় এবং ভারতসহ বহির্ভারতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭-৪৮ সালে রামকিংকর থিয়েটারের দৃশ্যসজ্জার কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৫০ সালে তাঁর আঁকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিটি বর্তমানে হাঙ্গেরিতে রয়েছে। ১৯৫১ সালে তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘যক্ষ-যক্ষিণী’ দিল্লীর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে প্রতিষ্ঠা করা হয়।




১৯৬০ সালে বিশ্বভারতীয় ছাত্ররা রামকিংকরের ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। পরের বছর কলকাতায় প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়। রামকিংকর ‘কিংবদন্তী শিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তিনি শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ, নাট্যঘর প্রভৃতি ভবনের একাধিক ভাস্কর্য কর্ম করে শান্তিনিকেতনকে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত মূর্তিটি সম্পূর্ণ করেন। ১৯৬৯ সালে ‘UNESCO’ আয়োজিত ইউরোপীয় এক সভায় ‘শান্তিনিকেতন ও মডার্ন আর্ট মুভমেন্ট’ শীর্ষক এক বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি ভারতীয় শিল্পভাবনাকে বিশ্বে প্রসারিত করেন। ১৯৬৯ ও ১৯৭৩ সালে তাঁর জীবন ও কাজের উপর দু’খানি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়। ১৯৭০ সালে ভারত সরকার রামকিংকরকে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত করেন।




১৯৭১ সালে রামকিংকর কলাভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে তিনি কলকাতার S.S.K.M. হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে থাকাকালীনই কাদা দিয়ে তিনি জীবনের শেষ ভাস্কর্যটি (ছোট্ট দুর্গামূর্তি) নির্মাণ করেন। ১৯৮০ সালেই কিংবদন্তী শিল্পী রামকিংকর বেইজ ইহলোক ত্যাগ করেন।




শিল্পী হিসেবে রামকিংকর ছিলেন আত্মভোলা; কাজই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। অবীনন্দ্র-নন্দলালের যোগ্য উত্তরসূরী হলেও তিনি ছিলেন নিজস্বতার গুণে সম্পৃক্ত। তিনি ছিলেন রিলিফ কাজের ‘স্টাকো’ পদ্ধতির স্রষ্টা। ব্যক্তিজীবনের সারল্যের মতই ভাস্কর্য নির্মাণেও সহজলভ্য বস্তুর ও সরলতার সংযোজনে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। নিসর্গ চিত্রাঙ্কনেও তিনি পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন পথের দিশা দেখিয়ে গেছেন। শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছাত্রকূলকে অতিমাত্রায় প্রভাবিত করতে সক্ষম হন।




পাশ্চাত্যের প্রতি রামকিংকরের অনীহা না থাকলেও তিনি ভারতীয়তার উর্ধে কোনো কিছুকেই স্থান দেননি। রামকিঙ্কর বেইজ এর আঁকা ছবি বৃহৎ  শিল্পকর্মের ভাণ্ডারে সবকিছুর প্রকাশই ছিল সাবলীল। ভাস্কর্যগুলির মধ্যে ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘কৃষ্ণ গোপিনী’, ‘সুজাতা’, ‘বুদ্ধ’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘যক্ষ-যক্ষিণী’, ‘মৎস্য মহিয’, ‘শস্যকৰ্তন’ ইত্যাদি ছিল বিখ্যাত। তাঁর আঁকা চিত্রকর্মের মধ্যে ‘পিকনিক’, ‘মা ও ছেলে’, তাঁর মায়ের প্রতিকৃতি, বৌদির প্রতিকৃতি, ‘হার্ভেস্ট’, ‘কৃষ্ণজন্ম’, ‘ধানের ক্ষেত’, ‘সাঁওতাল রমণী’ ইত্যাদি ছবিগুলি সকলের পরিচিত। বাংলা তথা ভারতবর্ষের ভাস্কর্য, চিত্রের ইতিহাসের রামকিঙ্কর বেইজের অবদান অনস্বীকার্য।







Share Post :

Leave a Comment