StudyMamu

আদি মধ্যযুগে উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

June 26, 2022

আদি মধ্যযুগে উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও 

অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে উড়িষ্যার মন্দিরশৈলী একটি ধারাবাহিকতার চিহ্ন বহন করে চলেছিল। দীর্ঘদিন ব্যাপী পরাক্রান্ত ‘শৈলোদ্ভব’, ‘ভৌম’, ‘সোম বংশ’, ‘চোড়বঙ্গ’, ‘সূর্যবংশ’ প্রভৃতি রাজবংশের অধীনে উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যশৈলীর বিকাশ ঘটে। মূলত ভূবনেশ্বরের মন্দিরগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই স্থাপত্যশৈলী ‘ভূবনেশ্বর মন্দিরশৈলী’ নামেও পরিচিত। উড়িষ্যার স্থাপত্যশিল্পে মন্দিরের প্রতিটি অংশের ও অলঙ্করণের বিশিষ্ট নাম আছে।

উত্তর ভারতীয় ‘নাগর’ (শিখর বা দীর্ঘ চূড়াওয়ালা মন্দির) রীতির মন্দিরের প্রসার উড়িষ্যাতে যে রূপ গ্রহণ করেছিল তাতে মন্দিরকে প্রধানত গর্ভগৃহের উপরিস্থিত ‘রেখদেউল’ (চূড়াওয়ালা মন্দির) ও তার সামনের মন্ডপটি ‘জগমোহন’ এবং ‘ভদ্রদেউল’ বা ‘পীরদেউল’—এই দু’টি অংশে ভাগ করা যেতে পারে। ‘রেখদেউল’-র শিখরটি বিবর্তনের সাথে সাথে ক্রমশ উঁচু হয়ে ওঠে। ‘পীরদেউল’ বা মন্ডপটি ক্রমশ ছোটো ও নীচু হয়ে পিরামিডের আকার ধারণ করে।

উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যে মন্দিরের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে। সর্বপ্রথমে মন্দিরের ‘বেদীকা’-র নাম ‘পিষ্ট’। ‘পিষ্ঠ’ থেকে  সোজা হয়ে শিখর পর্যন্ত বিস্তৃত অংশের নাম ‘বাড়’। ‘বাড়’ আবার তিনভাগে বিভক্ত—সবথেকে নীচের অংশের নাম ‘পাভাগ’, তার উপরে যথাক্রমে ‘তলজঙ্ঘ’ এবং এর মধ্যবর্তী স্থানে থাকে ‘বান্ধনা’ নামক সমান্তরাল অলঙ্করণ শ্রেণির জন্য চিহ্নিত স্থান। ‘বাড়’ ও শিখরের মধ্যবর্তী অংশের নাম ‘বরন্ড’—উপরিভাগ শিখর অথবা ‘গন্ডী’ নামে পরিচিত। শিখর বা ‘গন্ডী’-র শীর্ষে ‘মস্তক’। ‘মস্তক’-র প্রথমে একটু ভিতরে ঢুকে যাওয়া অংশকে বলে ‘বেকী’। ‘বেকী’-র উপরে চক্রাকারে চারদিকে গভীরভাবে খোদিত শিরাওয়ালা অলঙ্করণযুক্ত “আমলক শিলা’ বর্তমান। এই ‘আমলক শিলা’-র উপরে ক্রমান্বয়ে ‘খপুরি’, ‘কলস’ ও ‘ধ্বজা’ (পতাকা) বা মন্দির দেবতার ‘আয়ূধ’—শিবমন্দির হলে ‘ত্রিশূল’, নারায়ণ মন্দির হলে ‘চক্র’ইত্যাদি।

অন্যদিকে মন্দিরের ভিত্তি-সংস্থান অনুসারে প্রতিটি দিকের প্রধান প্রাচীর থেকে বেরিয়ে আসে ‘রথ’ নামক অংশ। যখন একটি ‘রথ’ মন্দিরের প্রাচীর থেকে বেরিয়ে আসে তখন তার দু’পাশে দু’টি ‘পার্শ্বরথ’-র সৃষ্টি হয় এবং মন্দিরের নাম হয় ‘ত্রিরথ’। এইভাবে ‘পঞ্চরথ’, ‘সপ্তরথ’ ও ‘নবরথ’ মন্দিরও পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছিল। বেরিয়ে আসা ‘রথ’-গুলি যখন মন্দিরের শিখরে অনুসৃত হয় তখন এগুলিকে বলা হয় ‘পগ’। শিখরের প্রত্যেকদিকে মধ্যবর্তী ‘পগ’-কে বলা হয় ‘রাহাপগ’ এবং কোণের ‘পগ’-গুলিকে বলা হয় ‘কোণক পগ’।

মুক্তেশ্বর মন্দির :

উড়িষ্যার স্থাপত্য রীতির বিবর্তনে মুক্তেশ্বর মন্দিরটি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। দশম শতাব্দীতে মুক্তেশ্বর মন্দিরটি নির্মিত হয় (৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ)। এই মন্দিরটির শিখর সুন্দর চৈত্য-গবাক্ষ, নায়িকা ও গণমূর্তি দিয়ে সজ্জিত। মন্দিরের গর্ভগৃহ ‘পঞ্চরথ’-র আকার ধারণ করে। মন্দিরটি কারুকার্যশোভিত একটি প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশের মুখে রয়েছে একটি মকর তোরণ। মুক্তেশ্বরের পর সিদ্ধেশ্বর ও কেদারেশ্বর মন্দির শিল্পশোভায় আরও মহান হয়ে ওঠে।

রাজা-রাণী মন্দির :

একাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে উড়িষ্যায় নির্মিত রাজা-রাণী মন্দিরের শিখরটির চারিপাশে অবস্থিত ছোটো ছোটো ‘অঙ্গশিখর’ (মূল শিখর থেকে নির্গত) আমাদের পশ্চিম ভারত ও মধ্যভারতের মন্দির-স্থাপত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালের অলঙ্করণ অতুলনীয়। রাজা-রাণীর মন্দিরের ভাস্কর্যগুলি বৃহৎ, সাবলীল ও প্রাণবন্ত।

লিঙ্গরাজ মন্দির :

উড়িষ্যার মন্দিরগুলির মধ্যে ভূবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরকেই হিন্দু মন্দিরগুলির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট বলে গণ্য করা হয়। এই মন্দিরটির নির্মাণকাল একাদশ শতাব্দী (১১০০ খ্রিস্টাব্দ)। ভূবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরের চারটি প্রধান অংশ ১। ‘ভোগমণ্ডপ’ বা ভোজনালয়, ২। ‘নাটমণ্ডপ’ বা নৃত্যগৃহ, ৩। ‘জগমোহন’ বা দর্শনগৃহ এবং ৪। ‘দেউল’ বা দেবগৃহ। লিঙ্গরাজ মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এর সুউচ্চ দেউল। দেউলে শিখরের উচ্চতা ১৬০ ফুট। মন্দিরটির চারদিক ঘিরে একটি প্রাচীরের দেওয়াল রয়েছে। দেওয়ালের প্রাচীরে গণেশ, কার্তিক, পার্বতী এবং রামায়ণ ও মহাভারতের ঘটনার ছোটো ছোটো অপূর্ব ভাস্কর্য বিদ্যমান। এর চারদিকে বড় বড় সিংহ দরজা, মাঝখানে পাথর বাঁধানো চত্ত্বর বা উঠোন। উঠোনের মাঝখানে বিশাল শিবমন্দির আকাশ ভেদ করে আপন মহিমায় বিরাজমান। লিঙ্গরাজ মন্দিরকে উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যশিল্পের ‘রত্ন’ বলা হয়।

পুরীর জগন্নাথ মন্দির :

লিঙ্গরাজ মন্দিরের পর উড়িষ্যার মন্দিরশিল্পের পরিচয় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। জগন্নাথ মন্দিরটির নির্মাণ শুরু করেনঅনন্তবর্মন চোড়গঙ্গ (১১০০ খ্রিস্টাব্দে) এবং অনেক পরে এটি সম্পূর্ণ হয়। এই মন্দিরের আয়তন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ৩১০ X ৮০ ফুট। শিখরের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মন্দিরের ফটকে শ্রীকৃষ্ণের জীবন নিয়ে নানা ছবি এবং ভিতরে জগন্নাথ, শুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি স্থাপিত আছে। মন্দিরটি আকারে যতটা বৃহৎ ও উচ্চ ভাস্কর্য অলঙ্করণে ততটা পূর্বতন মন্দিরগুলির মত সুন্দর ও সূক্ষ্ম নয়।

Share Post :

Leave a Comment