সিসিলি অভিযানের কারণ ব্যাখ্যা করো।
সিসিলি অভিযান পেলোপনেসীয় যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।এথেন্সের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকেই এই আবেগ বা প্রেরণার জন্ম হয়েছিল। থেমিস্টক্লিসের সময় থেকেই সিসিলির উপরে এথেন্সিয় কর্তৃপক্ষের নজর পড়েছিল। তারপর থেকে সিসিলির সঙ্গে এথেন্সের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক পরিমাণে চলত।
ভূমধ্যসাগরের পশ্চিম অঞ্চলে এথেন্সের বাণিজ্যিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সিসিলিতে এথেন্সের রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করা যে একান্ত প্রয়োজন, তদানীন্তন এথেনীয় নেতৃবৃন্দ এটা ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই সিসিলি অঞ্চলে সাইরাকিউজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি দেখে এথেন্সের শঙ্কিত হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
সিসিলির আইওনীয়ান রাষ্ট্রগুলি অর্থাৎ সেজেস্টা, লিয়ান্টিনি ও রিজিয়ামের সঙ্গে এথেন্স বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিল। সিসিলিতে যে প্রচুর সংখ্যক ডোরিয়ান রাষ্ট্র ছিল, বিশেষ করে করিন্থের উপনিবেশ ও মিত্ররাষ্ট্র সাইরাকিউজের বিরুদ্ধে আইওনীয়ান রাষ্ট্রগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করা এথেন্সের উদ্দেশ্য ছিল। এজন্য এথেন্স খ্রিঃ পূঃ ৪৪৩ অব্দে থুরী উপনিবেশটি স্থাপন করেছিল। কিন্তু থুরীতে এথেনীয়দের চেয়ে অন্যান্যদের সংখ্যা বেশি হওয়ায়, এথেন্স তেমন লাভবান হল না। পশ্চিম অঞ্চলে এথেন্স তখন শুধু তার প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। বাণিজ্য পরিস্থিতি এবং করিন্থের সঙ্গে এথেন্সেরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমেই এথেন্সকে ইতালী ও সিসিলির ব্যাপারে জড়িয়ে ফেলে।
৪৬১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সিসিলি দ্বীপের প্রধান রাষ্ট্র সাইরাকিউজ লিয়ন্টিনি দখল করে নেয়। নির্বাসিত লিয়ন্টাইন নেতারা এথেন্সের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানাল। ঐ বছরই সেজেস্টা ও সেলিনাসের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে, সিসিলির সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাষ্ট্র সাইরাকিউজ সেলিনাসের সাহায্যার্থে এগিয়ে যায়। সেজেস্টা অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে এথেন্সের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। সেজেস্টাবাসীরা এথেন্সের অভিযানের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেজেস্টার প্রস্তাব নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য একলেশিয়ার অধিবেশন ডাকা হল। এই অধিবেশনে শান্তিকামী রক্ষণশীল দলের নেতা নিকিয়াস এথেন্সের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক দলের নেতা অ্যালকিবাইডিস এথেন্সকে অবিলম্বে সেজেস্টার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। উভয় নেতার বক্তব্য শুনে একলেশিয়ার অধিকাংশ সদস্যই অ্যালকিবাইডিসের প্রস্তাব সমর্থন করল। সিসিলির বিরুদ্ধে এক বিরাট সামরিক অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।
অ্যালকিবাইডিস, নিকিয়াস ও ল্যামাকাস প্রমুখকে সমান অধিকার দিয়ে এথেন্সের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিকিয়াস শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। কোন রাষ্ট্রই কখনো এত বড় অভিযান কোথাও চালায়নি। এই অভিযানে একশো চৌত্রিশটি যুদ্ধজাহাজ ও নাবিক মিলে ছিল ত্রিশ হাজার। সিসিলির মিত্ররা অশ্বারোহী দেবে, এই আশায় মাত্র ত্রিশটি ঘোড়া নৌবাহিনীর সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল।
নৌবহর যেদিন যাত্রা করবে, সেদিন সকালে দেখা গেল যে, কে বা কারা এথেন্সের সমস্ত মন্দিরে এবং অনেকের গৃহদ্বারে হারমি (Herme) নামক দেবতাদের মূর্তিগুলি ভেঙে ফেলে। রেখেছে। অনেকে এই অর্ধমাচরণের জন্য নাস্তিক বলে কথিত অ্যালকিবাইডিসকে দায়ী মনে করল। কিন্তু প্রকাশ্য বিচারালয়ে অ্যালকিবাইডিসের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হয়নি। অ্যালকিবাইডিস বিচারে নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার পূর্বে অভিযানে যেতে রাজী হলেন না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে যেতে হল। নির্দিষ্ট দিনে নৌবহর সিসিলির উদ্দেশে যাত্রা করল।
সিসিলিতে পৌঁছানোর পর দেখা গেল যে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অভিযানের ব্যয়ভার বহন করা সেজেস্টার পক্ষে সম্ভব নয়। রিজিয়ামও জানিয়ে দিল, তার পক্ষে তেমন সাহায্য করা সম্ভব নয়। অধিকন্তু ইতালীয় অন্যান্য গ্রীক রাষ্ট্রের মনোভাব বুঝে সে তার কর্মপন্থা ঠিক করবে বলে জানিয়েছিল। এমতাবস্থায় তিনজন সেনাপতি পরস্পর বিরোধী তিনটি পরিকল্পনা উপস্থাপিত করলেন। নিকিয়াস সেলিনাসের সঙ্গে সন্ধি করে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। ল্যামাকাস কালক্ষেপ না করে সাইরাকিউজআক্রমণ করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু অ্যালকিবাইডিস সিসিলিতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করে কূটনীতির সাহায্যে সিসিলিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাহায্য লাভ করে, প্রচণ্ড শক্তিতে সাইরাকিউজ ও সেলিনাসের বিরুদ্ধে আঘাত হানবার পক্ষপাতী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত অ্যালকিবাইডিসের পরিকল্পনাই গৃহীত হল। কিন্তু এর অব্যবহিত পরেই অ্যালকিবাইডিসকে সেই হারমি-সংক্রান্ত অধর্মাচরণের অভিযোগের বিচারার্থে এথেন্সে ডেকে পাঠানো হল। অ্যালকিবাইডিস স্বদেশে না গিয়ে স্পার্টায় পালিয়ে যান এবং এবার স্বদেশের বিরুদ্ধে স্পার্টার হয়ে সাহায্য করলেন।
অ্যালকিবাইডিসের পরামর্শক্রমে স্পার্টা গিলিপাসের (Gylippus) নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী সাইরাকিউজকে সাহায্যের জন্য পাঠাল। অপরিণামদর্শী নিকিয়াস যে প্রাচীর অসমাপ্ত রেখেছিলেন, স্পার্টার বাহিনী সেখান থেকে সহজেই সাইরাকিউজে ঢুকে পড়ল। যে সাইরাকিউজ এতদিন বার বার সন্ধি প্রস্তাব করছিল, স্পার্টার বলে বলীয়ান হয়ে এবার পালটা আঘাত হানতে লাগল। পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত ভেবে নিকিয়াস এথেন্সে বলে পাঠালেন যে, হয় তাকে ফিরিয়ে নেওয়া হোক, নয় প্রচুর সাহায্য পাঠানো হোক। নিকিয়াসের শক্তি বৃদ্ধির জন্য এথেন্স থেকে ডেমস্থিনিস ও ইউরিমেডনের নেতৃত্বে নতুন সৈন্যবাহিনী সিসিলিতে পাঠানো হল। ইতিমধ্যে সাইরাকিউজ এক নৌযুদ্ধে জয়লাভ করলে নিকিয়াসের অবস্থা আরো সঙ্গীন হল। ডেমস্থিনিস পরিস্থিতি দেখে যুদ্ধজয়ের আশা ছেড়ে দিলেন। তিনি নিকিয়াসকে সাইরাকিউজ পরিত্যাগের পরামর্শ দলেন। কিন্তু নিকিয়াস সে পরামর্শ গ্রহণ করলেন না। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিকিয়াস শেষ পর্যন্ত সাইরাকিউজ পরিত্যাগে রাজী হলেন।
সাইরাকিউজ এথেনীয় নৌবহরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করল। জলপথে যে এথেনীয় বাহিনী পালাবে, সে পথও রইল না। স্থলপথে পালাতে গিয়ে এথেনীয় বাহিনী শত্রুহস্তে বন্দী হল। নিকিয়াস, ডেমস্থিনিস এবং ইউরিমেডন বন্দী অবস্থায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। এমনিভাবে এথেন্সের বিপুল আয়োজনের সিসিলি অভিযান বিরাটতর ধ্বংসে পর্যবসিত হল।
এই অভিযানের ব্যর্থতা যে পরিণামে এথেন্সের পতনকেই ডেকে আনবে, সে কথা তাদের বোঝা উচিত ছিল।