ফিরোজ শাহ তুঘলকের জনহিতকর কার্যাবলী। ফিরোজ শাহ তুঘলক-কে সুলতানি যুগের আকবর বলা কতটা যুক্তিযুক্ত।
সমসাময়িক কালের ঐতিহাসিক বিবরণ সুলতান ফিরোজ শাহের দীর্ঘ শাসনকালে (1351-88) গৃহীত ব্যবস্থা গুলি প্রশংসিত হয়েছে। বরণী লিখেছেন যে ফিরোজকে মহম্মদ বিন তুঘলকের নিজের উত্তর অধিকারী মনোনীত করলেও তাঁর সিংহাসন লাভ নিষ্কণ্টক ছিল না। অসীম ধৈর্য ও কৌশলের পরিচয় দিয়েন অভিযোগের স্বপক্ষে নিয়ে এসে নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক।
তিনি একজন সফল সুদক্ষ এবং নিরপেক্ষ সুলতান হয়ে উঠতে পারেননি তার আমলেই সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের বন্ধ হয়ে গিয়ে শুরু হয় অবক্ষয়ের প্রক্রিয়া কিন্তু তার শাসনকালে কোন বৈদেশিক আক্রমণ বা বড় রকমের বিদ্রোহ ঘটে নি। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ছিল আয়ত্তের মধ্যে বেতন ও মজুরি বিস্ময় ও বিশেষ কারও ক্ষভ ছিল না। সম্ভবত এটা অর্থের দিকে নজর দেখেই বরণীয় আফিফ তাকে এক আদর্শ ও প্রজাহিতৈষী মুসলমান শাসক এর মর্যাদা দিয়েছেন।
সিংহাসনে বসেই তিনি অভিজাত, উলেমা,অধিস্তন রাজ কর্মচারী সেনাবাহিনী ও সাধারণ কৃষকের আস্তা অর্জনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সামশ-ই-সিরাজ আফিফ তাঁর “তারিখ-ই-ফিরোজশাহী” গ্রন্থে, সুলতানকে উদারতার প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। সুলতানের ধারণা ছিল প্রজারঞ্জন করতে পারলে অনেক ত্রুটি চাপা দেওয়া সম্ভব। তাই রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে তিনি সামগ্রিক উন্নয়নে যন্ত্রবান ছিলেন। কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গ কে আচ্ছন্ন করেছিল তার ধর্ম বিশ্বাস ফলে প্রজারঞ্জনের ইচ্ছা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সাম্রাজ্যের ভিত্তিও দুর্বল হয়ে যায়।
রাজকীয় কর্তব্য সম্পর্কে নিজের ধারণা ফিরোজ স্বয়ং “ ফুতুহাত-ই-ফিরুজশাহী” তে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পূর্ববর্তী শাসকদের আমলের প্রজাদের দৈহিক নির্যাতন (শিয়াস্ত) ও শাস্তি দানের প্রথার বিলুপ্তি ঘটান। একই সঙ্গে ক্রীতদাসের প্রতি তার সদয় ব্যবহারেও উল্লেখ করেছেন। সমসাময়িক কালের ঐতিহাসিকরা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তিনি সর্বপ্রকার উৎপীড়ন নিষিদ্ধ করেছিলেন। ইতিপূর্বে কৃষকদের দুর্ভিক্ষ ও অজন্মার সময় যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল তা তিনি মকুব করে দেন। সমগ্র রাষ্ট্রের রাজস্বের অনুমান ভিত্তিক হিসেব থেকে জানা যায় যে খালসা এবং সরাসরি শসিত এলাকার আই ছিল 6 কোটি 80 লক্ষ টাকা তঙ্কা।
1375 সালে তিনি পূর্ববর্তী আমলের বহুকর শরীয়ত বিরোধী বলে বাতিল করে দেন। ভবিষ্যতে কর আদায়ের জন্য অবশ্য সুলতান কয়েকটি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। খরাজ (ভূমিকর),উশর,খামস, জিজিয়া ও জাকাৎ আদায়ের মাধ্যমে সুলতান একদিকে যেমন মৌলবাদীদের সমর্থন পেয়েছিলেন তেমনি প্রজা সাধারণের করভার লঘু করার চেষ্টা করেছিলেন। অমুসলিমদের ভূমিকর এর পরিমাণ ছিল উৎপাদনের ⅒ অংশ। খামস ছিল যুদ্ধে লুন্ঠিত সম্পদের ⅕ অংশ। অবিশ্বাসী বিশেষত অমুসলমানদের দেয় ধর্মীয় কর ছিল জিজিয়া। জাকাৎ ছিল মুসলমানদের সম্পত্তির ওপর শতকরা 2 ভাগ।
ফিরোজ রাজস্বের জমি সরকারি কর্মচারী বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে বেতনের পরিবর্তে বিলি বন্দোবস্ত করেছেন। এর ফলে ইক্তা জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও রাষ্ট্রের আয় কমতে থাকে। নিজমির মতে আগের মতই তার আমলেও সরকারি কর্মচারীরা খাজনা আদায় করত। তবে সুলতান যাদের সঙ্গে জমি বন্দোবস্ত করতেন তারা নিজ নিজ এলাকায় কৃষকদের ওপর অন্যায় ভাবে কর আদায়ের সুযোগ পেতেন। এক্ষেত্রে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে কোনো উপায় ছিল না। অধ্যাপক নিজমি ফিরোজের এই রাজস্ব বিলি ব্যবস্থা ও কর্মচারীদের অবাধ দুর্নীতি তার প্রজাহিতেষনার অন্তরায় বলে মনে করে তাকেই সুলতানি শাসনের অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করেন। তাছাড়া দেশের প্রায় সমস্ত সরকারি পদ গুলিকে বংশানুক্রমিক করে ফেলাই অবিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন।
কৃষি জনসাধারণ তথা রাজ কোষের অর্থাগামের প্রধান উপায় হাওয়াই কৃষির সম্প্রসারণ এর জন্য তিনি সুষ্ঠ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তারিখ-ই-মুবারকশাহী তে জল সেচের জন্য ফিরোজের বেশ কয়েকটি সেচ খাল নির্মাণের কথা বিস্তৃতভাবে বলা আছে। দেশের বৃহৎ খাল গুলি নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বহন করত কেন্দ্রীয় সরকার। আর ছোট খাল ও জলাশয় নির্মাণের ভার ছিল প্রাদেশিক সরকার ও জমি ভোগ কারীদের উপর। এর ফলে শুধু দোয়াব অঞ্চলেই প্রায় 52টি নতুন বসতি গড়ে ওঠে। শস্য উৎপাদনের হার ও বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর মাধ্যমে উপকৃত অঞ্চলে বোধিত উৎপাদনের উপর শতকরা দশ ভাগ শেষ কর হক-ই-শিরাহ আদায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। আফিফের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে দিল্লির অন্য কোন সুলতান ই ফিরোজের মতো ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হতে পারেন নি।
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বেকারদের চাকরি দেওয়া চেষ্টা করেন। কয়েকটি নতুন নগর নির্মাণ করেন এর মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল ফিরোজবাদ, জৈনপুর, হিসার ও ফিরোজপুর তিনি চারটি মসজিদ একটি প্রসাদ অজস্য সরাইখানা 5টি জলাশয় ও দাতব্য চিকিৎসালয় বা দার-উস-সাফা, 21টি সমাধিস্তম্ভ ,10টি স্নানাগার, 10টি হয় স্মৃতিসৌধ, ও একটি সেতু নির্মাণ করেন। দিল্লি ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে 1200 উদ্যানের ফল থেকে প্রায় এক লক্ষ 80 হাজার তঙ্কা রাজ কোষের লাভ করত। বিদ্যানুশীলনে প্রবল উৎসাহী ফিরোজ শাহ 30টি মাদ্রাসা ও 3টি উচ্চ শিক্ষায়তন স্থাপন করেন। ইতিহাস চর্চার প্রতিও তার প্রবল আগ্রহ ছিল। নিজের লেখা ছাড়াও তার পৃষ্ঠপোষক তাই রচিত হয়েছিল জিয়াউদ্দিন বরনী ও আফিফের গ্রন্থা গুলি। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র জানিয়েছেন যে সংগীত বিষয়ে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ও এ সময় ফারসিতে অনূদিত হয়েছিল।
দরিদ্রের সাহায্যের জন্য সুলতান দেওয়ানী ই খরিয়ত এর সৃষ্টি করেছিলেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা এবং বিধবা পিতৃমাতৃহীন শিশুদের আর্থিক সহায়তা করলেও তা মূলত মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এসময় দিল্লিতে তিনটি রাজকীয় কারখানা ছিল। ফিরোজের অজস্র ক্রীতদাসের মধ্যে অনেকেই কারখানায় নিযুক্ত হতেন এবং এখানে উৎপাদিত হতো সুলতানের দরবারে ও সরকারের প্রয়োজনীয় পণ্য। সুলতান ক্রীতদাসদের সংখ্যা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছিলেন যে তার রাজস্বের শেষার্ধে তারা শাসন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ শুরু করেছিল এবং তার মৃত্যুর পর 1388-94 এর মধ্যে তারা kingmaker এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
সাম্রাজ্যের অবক্ষয় এবং ধ্বংস রোধের জন্য সুলতান আমির-ওমরাহ , উলেমা ও সৈন্য বাহিনীর প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। যে সামরিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে সুলতানি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তার স্বকীয়তা বজায় রাখার প্রতি তিনি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন না। অভিজাত ও সৈন্যদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য তিনি ঘোষণা করেন যে এদের মৃত্যুর পর ইক্তা সমেত প্রয়াতের পদ পাবেন তার পুত্র পৌত্র জামাতা এমনকি উত্তরাধিকারীর অবর্তমানে ক্রীতদাস।
এভাবে সৈন্যবাহিনীতে এবং প্রশাসনের উত্তরাধিকার সূত্রে অযোগ্য অকর্মণ্য ব্যক্তিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সেনাবাহিনীতে নগদ এর পরিবর্তে ইক্তা হস্তান্তরিত করায় এক তৃতীয়াংশ মূল্যে রাজধানীতে ক্রয় করে বিভিন্ন প্রদেশে সরকারের কাছে অর্ধেক মূল্য বিক্রি করায় দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। পরিদর্শক বা কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে বাতিল ও দেখিয়ে তারা স্বপদে বহাল থাকবেন।
ফিরোজ অভিজাত ওদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো রাজকোট থেকে উচ্চহারে বেতনের ব্যবস্থা করেন। ডক্টর সতীশ চন্দ্র এর মতে দেখা যায় যে খান ও মালিকদের ব্যক্তিগত বেতন ছিল বছরে চার লক্ষ থেকে আট লক্ষ তঙ্গা । ফিরোজ কৃষি ও সেচ ব্যবস্থায় যে ধারাবাহিক উন্নতি ঘটানো তাদের প্রত্যক্ষ সুফল লাভ করেছিল ইক্তাদাররা। ফেরলান্ড তাই লিখেছেন যে ফিরোজের রাজত্বে অভিজাত ও আমলাদের স্বর্ণযুগ চলেছিল। ফিরোজ উলেমা সম্প্রদায়কে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন সাম্রাজ্যকে ঐইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে বিচারক শিক্ষা বিভাগে উলেমাদের উচ্চপদ দিয়ে তিনি প্রশাসন এক অহিতকর উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন।
হিন্দুদের সম্পর্কে তার নীতি ছিল বিদ্বেষমূলক। হিন্দু ও ব্রাহ্মণদের উপর জিজিয়া কর প্রবর্তনই নয় তাদের ধর্মান্তর করণীয় সুলতান প্ররোচিত করতেন। সমকালীন ঐতিহাসিক উপাদানের প্রাপ্ত হিন্দু নিধন ও মন্দির ধ্বংসের বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে সুলতানের উদার ও সহিষ্ণুতার তথ্য মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় । ফেরেশতার বিবরণে নগরকোট আক্রমণের সময় মন্দির ধ্বংস ও বিগ্রহ অপবিত্র করণের তথ্য পাওয়া যায়। আফিফ স্বীকার করেছেন যে প্রশাসন ছিল মুসলমানদের কুক্ষিগত কোন হিন্দুর উচ্চপদ প্রাপ্তির অধিকার ছিল না।
মূল্যায়ন :
প্রজা কল্যাণমূলক কাজের জন্য হেনরি এলিয়ট ও এলফিনস্টোন এর মত কোন কোন ঐতিহাসিক ফিরোজ শাহ তুঘলক কে সুলতানি যুগের আকবর বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই ধরনের গোঁড়ামি ও পক্ষপাতিত্বের কারণে ডক্টর স্মিথ ও ঈশ্বরী প্রসাদ এই কবি মহৎ গ্রহণে রাজি নন। ভিন্সেন্ট স্মিথ তার Oxford History of India ” it was not possible for him in his age to rise,as Akbar did to the conception that the rule of Hindustan should cherish all his subjects alike, ,whether Muslim or Hindu, and allow everyman apsolute freedom not only of conscience but off public worship “
ঈশ্বরী প্রসাদ ব্যঙ্গ করে লিখেছেন যে মহান উদার আকবরের গুণাবলীর 1 শতাংশ ফিরোজ এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফিরোজ ছিলেন গোড়া সুন্নি মুসলমান । মিশ্র জন্ম প্রস্তুত হীনমন্যতা বা বিশুদ্ধ মুসলিম রক্তের গর্ব করতে না পারায় তিনি সংকীর্ণ ধর্মীয় নীতির মধ্য দিয়ে এ তথ্য প্রচারে আগ্রহী ছিলেন যে পূর্ববর্তী শাসকের থেকে তার ইসলাম অনুরূপ কম নয়। তিনি শুধু হিন্দু নয় সিয়াও সৈয়দের বিদ্বিষ্ট ছিলেন।