StudyMamu

কর্তাভজা সম্প্রদায় টীকা ।

February 25, 2022

 কর্তাভজা সম্প্রদায় টীকা ।



  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে কর্তাভজা সম্প্রদায় বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। আউল চাঁদ নামক একজন সাধক এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সম্প্রদায়ের মতে শ্রীচৈতন্য আউল চাঁদ রূপে পুনরায় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন ও গুরু সত্য এই মন্ত্র প্রচার করেন। ইহা বৈষ্ণব ধর্মের ই একটি শাখা প্রশাখা ও নিজেদের মধ্যে সহজ ধর্ম সত্য ধর্ম বলে পরিচিত। এই ধর্ম মতে গুরুই পৃথিবীতে ভগবানের একমাত্র প্রতিনিধি অবিচলিত নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে ঈশ্বরজ্ঞানে গুরু সেবাই এই ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দলের মধ্যে কোনো জাতিভেদ ছিল না। হিন্দু মুসলমান সকলেই সকলের অন্ন ভোজন করতেন । 


  কাঁচরাপাড়ার উত্তর-পশ্চিমে পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত ঘোষপড়া গ্রামে এই সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র ছিল। ইহার প্রতিষ্ঠাতা আউলচাঁদ এর 22 জন শিষ্যের মধ্যে সদগোপ,কলু,মুচি প্রভৃতি হিন্দু ও কয়েকজন মুসলমান ছিলেন। আউলচাঁদের মৃত্যুর (1769) পর পর 22 জন শিষ্যের অন্যতম এই গ্রামবাসীর ও সদগোপ বংশের রামশরণ পাল তাহার স্থানে গুরুর পদে অভিষিক্ত হন। রামশরনের মৃত্যুর পর (আ: 1783) তার পুত্র রামদুলাল এবং তাহার মৃত্যু হলে তার পুত্র ঈশ্বর পাল গুরু হন।


  1863 সালের সোমপ্রকাশ একজন লিখেছেন যে রামচরনের বাড়িতেই আউলচাঁদ এর মৃত্যু হয়। চাকদহের নিকট পরাবি গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়েছে। কতাভজা শ্রী ও পুরুষেরা এই বাড়িতে এক স্তম্ভে আবির ও পুষ্প মালা প্রভৃতি প্রদান করে ভক্তি প্রকাশ করে থাকে। ঘোষপাড়ায় একটি সমাজ বাড়িতে কেউ কেউ বলেন রামশরনের শ্রী সতীমার সমাধি করা হয়েছে। ধর্ম অবলম্বীরা রামশরনের স্ত্রী এর প্রতি অভিশয় ভক্তি  করে থাকেন।100 বছরের মধ্যে পাল দিকের 5 পুরুষ ও বঙ্গদেশের ভিতরে ভিতরে প্রায়ই এক লক্ষ কতাভজা হয়েছে। কর্তাভজার ধর্মাম্বলীরা বলে সকলেই একজনের পুত্র একমাত্র গুরুই সকলের পিতা। মফস্বলের গরুদের মহাশয় বলে সম্বোধন করা হতো।


   ইতর লোকের মধ্যে এই ধর্মের সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল। ভদ্র লোক সমাজ এদের থেকে দূরে থাকতে এবং তাদের ঘৃণা করত। হিন্দুদের স্বাস্থ্য ও ব্যবহার অনুসারে  স্ত্রী জাতির স্বতন্ত্র নেই। তাহাদের সকল সময়ে ও সকল অবস্থানেই পিতা-মাতা পতি ও পুত্রদের পরতন্ত্র হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু ধর্মের বিলক্ষণ স্বাতন্ত্র লাভ আছে। সংবাদপত্রে থেকে জানা যায় মেলা স্থলে কতাদের অভিশয় করাকরি আছে কেউ কোনো কুকর্ম করলে তৎক্ষণাৎ তাহার দণ্ডবিধান হয়। কিন্তু সচরাচর এ দেখতে পাওয়া যায় যে স্থানে মূর্খতা ও স্বতন্ত্র উভয়ের সেখানে কুক্রিয়ার  বিলক্ষণ আধিপত্য হয়। এছাড়াও জানা যায় যে বর্তমান কতা ঈশ্বর বাবু একটি শয্যায় স্মরণ করে আছেন অনেকগুলো স্ত্রীলোক তাহার চতুর্দিকে বসে কেউ পদসেবা করছে কেউ অঙ্গে চন্দন লেপন করেছে এবং কেউবা গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে। অনেক লোকের মুখেই শোনা যায় যে এই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে স্ত্রীবৃন্দাবনে প্রকৃতি লীলা টায় অনুষ্ঠিত হয়।


   1848 সালের 30 এ মার্চ তারিখে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, গত দোলযাত্রার পরের দিন সোমবার অপরাহ্ণ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আনন্দ নাম ও পবিত্র স্থানে ঘোষপাড়া নামক প্রসিদ্ধ গ্রামে রথযাত্রা দর্শন করতে গিয়ে স্ত্রী পুরুষ সহ নানান ধমের  মানুষের সাথে কতা উপাসক কে উপস্থিত দেখা গিয়েছিল। এছাড়াও সেই স্থানে ক্রেতা-বিক্রেতা রঙ্গদশী ও নিমন্ত্রিত প্রভৃতি অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল।


  1863 সালের সোমপ্রকাশ একজন প্রত্যক্ষদর্শী এই মেলার বিবরণ দিয়ে বলছেন, এই বছর দোলে প্রায় 65000 লোকের সমাগম হয়েছিল। তাদের মধ্যে চোদ্দ আনা স্ত্রীলোক কল কামিনী অপেক্ষা বেশ্যায়  অধিক , পুরুষদের সকলেই প্রায় মূর্খ। এখানে জাতিভেদ নেই। সকল জাতি সকলের মুখে অন্ন তুলে দেন। এখানে মুসলমানরা ও স্বাচ্ছন্দে ব্রাহ্মণদের মুখে অন্ন  প্রদান করেন। ঈশ্বর বাবুর বাড়িতে দুর্গোৎসব রাস ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বিদায় অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় সমুদায় জেলা হতে কর্তাভজা সম্প্রদায় এসেছেন, তাদের মধ্যে মুর্শিদাবাদের লোক অধিক। যে সমাজে স্ত্রীলোক লজ্জাও গৃহের বাইরে হতে সাহস পায়না, সেই শ্রী লোকেরা কতার অনুরোধ বহুসংখ্যক অপরিচিত পুরুষদের সহিত আমোদ করতে লজ্জিত হতেন না।


  অক্ষয় কুমার দত্ত এই সম্প্রদায়ের প্রতি বিবরণ দিয়ে বলেছেন”ব্যভিচার দোষ তাদের সকল গুন গ্ৰাস করিয়াছে। সম্প্রদায়ভুক্ত স্ত্রী পুরুষ ভ্রাতৃ ভাগিনি সম্বন্ধ স্থাপিত করিলেও পরস্পর একত্র বাসই তাহাদের সর্বনাশের হেতু হইয়া উঠিয়াছে।

Share Post :

Leave a Comment